বাংলার জনগণের দিল্লি বিরোধিতা হচ্ছে এক হাজার বছরের শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস

বাংলা বা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণের দিল্লি বিরোধীতার ইতিহাস হচ্ছে প্রায় এক হাজার বছরের শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ দিল্লির পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর বিরোধীতা করে আসছে প্রায় এক হাজার বছর ধরে এবং সাম্প্রতিককালের বিস্তারবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে আসছে অন্তত আশি বছর ধরে। তাই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণের দিল্লি বিরোধিতার আগ-পাছ বুঝতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।

দিল্লি যে উভয় পশ্চিমবঙ্গকে দখল করে রেখেছ এবং বাংলাদেশকে শোষণ করতে পারছে তার কারণ বঙ্গভূমির সমতলের মানুষদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম, ঘটি-বাঙ্গাল, বাঙালি-বিহারী ও বাঙালি-অহমিয়াসহ আরো বহুবিধ জাতিবিভেদ সৃষ্টি করে। আমরা এখানে একটি ক্ষুদ্র আলোচনার অবতারণা করছি যা আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ভারত বিরোধিতার নামে মূলত দিল্লীর আধিপত্য, সম্প্রসারণবাদ, আমলাতন্ত্র ও শোষণের বিরোধিতা করে। দিল্লীর শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয় অথচ চট্টগাম সমুদ্রবন্দর চায়, ট্রানজিট চায়, জল আটকাতে চায়। দিল্লি প্রতিদিনই সীমান্তে বাংলাদেশের গরীব মানুষকে খেয়ালের বশে হত্যা করে। দিল্লীর এই গণবিরোধি শাসকগোষ্ঠীর অপকর্মেরই বিরোধি বাংলাদেশের জনগণ। ভারতে বাংলাদেশ-বিদ্বেষ ও বাংলাদেশে দিল্লি-বিদ্বেষের প্রতিযোগিতার শেষ হবে ভারতীয় ও বাংলাদেশি পূঁজিবাদের উৎখাতের মাধ্যমে।

ভারত বলতে সর্বভারত বা ভারত, পাকিস্তান, বাংলা, সেভেন সিস্টার্স, কাশ্মীর, সিকিম, আন্দামান ইত্যাদি বোঝায়। ফলে ভারত বিরোধিতা কথাটি একটা জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। মুলত দিল্লি শোষণ করছে উপরোক্ত অঞ্চলগুলো। ভারত শব্দটি পরিত্যাগ করে দিল্লি বিরোধিতা বললে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়। বাঙালি সবসময় আবেগপ্রবণ; এক্ষেত্রেও আবেগকে প্রাধান্য দিচ্ছে; যুক্তি দিয়ে বিচার করে দিল্লির আধিপত্যকে রুখে দাঁড়ানো দরকার। আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদি দিল্লির পতন ঘটাবার জন্য পথ বের করা দরকার।

মোগলযুগে বাংলাকে শোষণ

১৫৭৫-১৭৫৭ দিল্লি বাংলাকে অধীন রেখেছিল। শায়েস্তা খানের সময় ১২০ বলদের গাড়ি বোঝাই সোনা ও রূপা দিল্লি খাজনার নামে জোর করে নিয়ে গেছে। মূলত বাংলার সম্পদ লুটেই শাহজাহানসহ অন্য সম্রাটেরা তাজমহল, ময়ুর সিংহাসনসহ বিভিন্ন পাশবিক জগতখ্যাত জিনিস তৈরি করে। ১৫৭৫ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত দিল্লি কী পরিমাণে বাংলার সম্পদ লুট করেছে তা জানা যায় না। সেই সময়ের দিল্লির বাংলা থেকে সম্পদ লুটের হিসাব বের করা দরকার।

তবে ১৭০০ সাল থেকে বা মুর্শিদকুলি খাঁর সময় থেকে কি পরিমাণ সম্পদ দিল্লি লুট করে নিয়ে গেছে তার মোটামুটি হিসাব পাওয়া যায়। বাংলার নবাবদের মধ্যে মুশিদকুলী ও সুজাউদ্দিন নিয়মিতভাবে দিল্লীর সম্রাটের প্রাপ্য রাজস্ব (Imperial tribute) পাঠিয়েছিলেন। তারা প্রতিবছর এক কোটিরও কিছু বেশি টাকা দিল্লীতে পাঠাতেন। সুজাউদ্দিন প্রতি বছর এক কোটি পচিশ লক্ষ টাকা দিল্লীতে পাঠাতেন বলে গ্রান্ট সাহেব মত প্রকাশ করেছেন। এরা দুজনে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা রাজস্ব ও সেই সঙ্গে বহুমূল্য উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। বাংলা থেকে দিল্লীতে পাঠানো উপঢৌকনের মধ্যে থাকত মসলিন, হাতির দাঁতের কাজ, ভাল কাঠের কাজ, হাতি প্রভৃতি। আলিবর্দী তার রাজত্বের প্রথমদিকে একসঙ্গে কিছু টাকা মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহকে পাঠিয়েছিলেন। সম্রাটের প্রতিনিধি মুরিদ খাঁকে তিনি কিছু উপঢৌকন দিয়েছিলেন।[১]

বাংলাদেশে মারাঠা আক্রমণ বা বর্গির আক্রমণ শুরু হলে আলিবর্দি খানও দিল্লীতে রাজস্ব পাঠান বন্ধ করে দেন। প্রাক-পলাশী যুগে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ এ দেশের কৃষি ও শিল্পের ক্ষতি করেছিল। মারাঠারা পুরো দশ বছর ধরে বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল। মারাঠাদের এই আক্রমণও বাংলাকে দুর্বল করে এবং বাংলাসহ পরে গোটা হিন্দুস্তান ব্রিটিশদের অধীনে যাবার পথকে সহজ করে।

আলিবর্দি খানের মতো সিরাজদ্দৌলাও দিল্লীতে কোনাে রাজস্ব পাঠাননি। মুশিদকুলী ও সুজাউদ্দিন দিল্লীতে যে রাজস্ব পাঠিয়েছিলেন। বাংলার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর নিঃসন্দেহে তার প্রভাব পড়েছিল। এ যুগে বাংলাদেশে টাকা খুব দুষ্প্রাপ্য। টাকার ক্রয় ক্ষমতাও খুব বেশি। ১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রূপপার সিক্কা টাকায় দিল্লীর রাজস্ব পাঠানাে হত। পরে জগৎশেঠদের দিল্লী শাখার মাধ্যমে হুণ্ডিতে সম্রাটের প্রাপ্য রাজস্ব পাঠানো যেত। সুতরাং ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবছর এক কোটি টাকা বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে উধাও হত। ফলে টাকা আরো দুষ্প্রাপ্য হত। জিনিস পত্রের দাম আরাে নামত। কৃষক ও কারিগর তার শ্রমের যথােপযুক্ত মূল্য পেত না। বাংলাদেশে সঞ্চয়ও কম হত। কৃষক ও কারিগর তার শ্রমের ফসল টাকার মাধ্যমে সঞ্চয় করতে পারত না। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হত।[১]

আরো পড়ুন:  প্রাচীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর সময়

আবার আওরঙ্গজেব আমলের লুণ্ঠন সম্পর্কে সামান্য তথ্য পাওয়া যায় প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লেখায়। তিনি লিখেছেন মুঘল আমলের পুরনো সাম্রাজ্যবাদি শোষণ প্রক্রিয়ায় আওরঙ্গজেব সুবে বাংলা থেকে বছরে এক কোটি টাকা রাজস্ব নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি মহারাষ্ট্রীয়রা যে ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন ও চৌথ আদায় করতো তার পরিমাণ ছিলো কয়েক কোটি টাকা।[২] আশা করি গবেষকগণ মোগল যুগে বাংলাকে শোষণের ইতিহাস তুলে ধরার ব্যাপারে উদ্যোগি হবেন।

নয়া-উপনিবেশিক আমলের বাংলাকে শোষণ:

দিল্লি ১৭৫৭ পরবর্তীকালে পুনরায় কিছুটা বাংলাকে শাসন করার সুযোগ পায় আবার দিল্লি রাজধানি হবার পর। সেটা ১৯১১ সালের দিকের কথা। ১৯৪৭ সাল থেকেই দিল্লি তার সমস্ত রাজ্যগুলোকে শোষণ করে আসছে। এই শোষণের প্রতিকার এখনো কোনো রাজ্যই দিল্লির কাছ থেকে পায়নি। দিল্লি কোনোদিন তার জন্যে দুঃখ প্রকাশও করেনি। দিল্লির ধনপতিদের এবং দিল্লির আধিপত্যকে ধ্বংস করেই কেবল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অসীম দারিদ্র এবং ভারতের কংগ্রেস দলটি ও তার সহযোগি বিজেপি ও সিপিআই-সিপিএমকে ভারত থেকে উৎখাত করেই কেবল দিল্লির আধিপত্যকে রোখা সম্ভব। দিল্লির শাসক বিজেপি-কংগ্রেস যে মানবতা ও সভ্যতার কলংক তা সারা দুনিয়াতে প্রচার করেই দিল্লির আধিপত্যকে রোখা সম্ভব।  দিল্লির পুঁজিপতি ও শাসকরা ভারতের প্রায় ২০টি জাতিকে পরাধীন করে রেখেছে। এই জাতিগুলো নিজস্ব স্বাতন্ত্র নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না। সবজাতির অর্থনীতি, ভাষা, সাহিত্য আজ দিল্লির অত্যাচারে ধ্বংস-প্রায়।এই অবস্থায় দিল্লি বিরোধিতা করার জন্য আমাদের অনেক যুক্তি-বুদ্ধি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা ও কার্যক্রম দরকার।

১৯৭১ সালের গণযুদ্ধে, ডিসেম্বরের তেরো তারিখ নরসিংদী মুক্ত হয়। সেদিন খুব ভোরে পাক বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। যখন নরসিংদী মুক্ত হয় তখন ভারতীয় বাহিনী নরসিংদী থেকে অনেক দূরে, কেবল ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছেছে। টি.অ্যান্ড.টি. ক্যাম্প দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ। ক্যাম্প দখলের পর ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। ঘরবোঝাই হালকা ও ভারী মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলাগুলি আর গ্রেনেড। কিন্তু এই অস্ত্র তাদের দখলে রাখা যায়নি। কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা হেলিকপ্টার নামলো। তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে বললেন। মুক্তিযোদ্ধারা দখল করা অস্ত্রসম্ভার ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিলেন।[৩] ভারতীয় দখলদার বাহিনী এভাবেই সারা দেশ থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র লুটে নিয়ে যায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক, তাঁরা আমাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাঁদের হাত ছেড়ে দিতে বললেন। আমরা দখল করা অস্ত্রসম্ভার ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে মনটা খারাপ করেই শিবপুর ফিরে এলাম। বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব ভারতীয় নাগরিকেরা কাজ করেন, তারা বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা বৈধ পথে ভারতে নিয়ে যান। অবৈধ পথে যে টাকা যায়, তা বিবেচনায় নিলে মোট পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।[৪]

আরো পড়ুন:  খুদাই খিদমতগর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চালিত অহিংস আন্দোলন

ভারতের লোকও বাংলাদেশে আসে: অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে ভারতের কোনো লোক বাংলাদেশে অবৈধভাবে যান না, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করেন না। আসলে এই কথাটি সঠিকনয়। অল্প হলেও ভারতের কিছু লোক বাংলাদেশে অবৈধভাবে আসেন, গোপনে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য কিছু লোক নিয়মিত আসেন। মালদাহ, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের গ্রামগুলো বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলোর মতোই দারিদ্রপীড়িত। সেই অঞ্চলের গরীব জনগণ বেঁচে থাকার তাগিদেই বাংলাদেশে মাঝে-মধ্যে আসতে বাধ্য হন।

আমাদের কী করণীয়ঃ মতামত তৈরিই প্রধান কাজ। দিল্লির বর্বরতার মুখোশ উন্মোচন করুন। দিল্লির শাসক গোষ্ঠীর যুদ্ধবাজ নীতির বিরোধিতা করলেই হবে না; দিল্লির লুটপাট ও দিল্লির অর্থনীতির খুঁটিনাটি দিকগুলো বিভিন্নভাবেউপস্থাপন করা দরকার। নরপিশাচ টাটা, বিড়লা, মুকেশ আম্বানিরা কীভাবে এতো টাকার মালিক হলো তা দেখানো দরকার জনগণকে। মুখোশ উন্মোচন করুন সিপিআইও সিপিএম-এর। এই দল দুটিই ফ্যাসিবাদি কংগ্রেসকে দিল্লিতে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে এবং নিজেরা সমাজতন্ত্র-ব্যবসা করেছে। যদি জ্যোতি বসুর মতো গণহত্যাকারী সুবিধাবাদিরা দিল্লির শাসক কংগ্রেসের লেজুড় হয়ে কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি না করতো তবে দিল্লির এই আগ্রাসি সাম্রাজ্যবাদিতাকে অনেক আগেই হত্যা করা যেত।

বাংলাদেশে দিল্লির সহযোগি কারা: বাংলাদেশে আওয়ামি লিগকে দিল্লির সহযোগি হিসেবে এবং বিএনপিকে পাকিস্তানের সহযোগি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বিএনপি ও আওয়ামি লিগ দুই দলই দিল্লির জন্য বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দুই দলই দিল্লির মিত্র মার্কিনের কাছে দেশের স্বাধিনতাকে লুটিয়ে দিয়েছে। টাকার শাসনের কাছে দুই দলই ইঙ্গ-মার্কিন-ভারত তোষণে সমান পারদর্শি। বিএনপি ও আওয়ামি লিগ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দিল্লির জগতশেঠরা বাংলাদেশ লুট করতে আসলে মিরজাফর, রায়দুর্লভদের অভাব হয় না। ঘসেটি বেগমদের সাথে মিসেস লর্ড ক্লাইভ ও জগতশেঠরা মিটিং করে গ্যাস, বন্দর, ট্রানজিট, নদীর পানি, ব্যাংকের-শেয়ার বাজারের টাকা, সব নিয়ে যেতে চায়।

দিল্লি তার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে: দিল্লি জনগণের সব রকমের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করছে। পৃথিবীর অস্ত্র ব্যবসায়িদের কাছে শীর্ষ  লোভনীয় স্থান ভারত। ২০০৭-২০১১ সাল পর্যন্ত দিল্লি ৬০,০০০ কোটি রুপির অস্ত্র আমদানি করেছে। ২০২০ সালের ভেতরে দিল্লি আরো ৯০,০০০ কোটি রুপির অস্ত্র আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইজরায়েল দিল্লির কাছে এই অস্ত্র বিক্রি করবে। অর্থাৎ দিল্লি যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তেমনি দিল্লির সাম্রাজ্যবাদিরা জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালাচ্ছে তা আরো অনেকদিন চলবে। কারণ এই যুদ্ধ ভারতের সর্বত্র এখনো ছড়ায়নি। জনগণের যুদ্ধ যদি কোনো শুভ পরিণতির দিকে না যায় তবে বাঙালিসহ সব জাতিগুলোরই জীবন চরম সংকটে পড়বে।

দিল্লীর শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে কেন: কাঁটাতারের বেড়ার প্রথম কারণ; বিজেপি-কংগ্রেসের নেতারা খুব ভালো করেই জানে পশ্চিমবাংলা, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার মানুষের ভেতরে স্বাধিনতাবোধ জাগলে গান্ধী-নেহেরু-আদভানি-মোদীর শক্তিমঞ্চ মহামহিম দিল্লির তখত-তাউস কয়েক মাসেই উলটে যাবে। দ্বিতীয় কারণ; বাংলাদেশসহ তার পার্শ্ববর্তি রাজ্যগুলোর মানুষগুলোকে মানসিকভাবে বন্দি ও নির্ভর রাখা যার শিকার অনেকেই। তৃতীয় কারণ; দিল্লীর পণ্য জোর করে বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাজ্যগুলোতে বিক্রি করা। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচলের মানুষের কী ঠেকা পড়েছে বাংলাদেশের পণ্য বাদ দিয়ে দিল্লির পণ্য কেনার।

সাম্রাজ্যবাদের ভড়ঙঃ সাম্রাজ্যবাদকে যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন তা আসলে মোটেই তত শক্তিশালি নয়। মার্কিনের সহায়তায় দিল্লি বেশিদুর এগোতে পারবে না। দিল্লির যুদ্ধ বন্ধ হতে বাধ্য। দিল্লির সাথে শত্রুতা বাড়ালে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি কি হবে? বাংলাদেশের স্বার্থেই দিল্লিকে সতর্ক করতে হবে। দিল্লি মার্কিনিদের কোলে ঢুকে মার্কিনিদের পরামর্শ ও সহায়তায় তার জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালাচ্ছে তা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যারা মনে করেন দিল্লির বিরোধিতা করলে বাংলাদেশটা পাকিস্তান হয়ে যাবে তাদের মাথায় রাখা দরকার যে দিল্লির বিরোধতা করলে দেশ পাকিস্তান হয় না বরং স্বাধীন থাকে, এবং দিল্লি যেসব জাতিকে পরাধীন করে রেখেছে তাদেরও নিপীড়ন থেকে মুক্ত হবার রাস্তা বের হয়।

আরো পড়ুন:  ভারতে বৃটিশ শাসন

বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির বিরোধিতা করে শ্রেণিসংগ্রাম ও ন্যায়যুদ্ধ করছে: বাংলাদেশের জনগণের টাকা টাটা বিড়লা মুকেশ আম্বানিরা লূট করে নিয়ে যাচ্ছে। দিল্লি চোরাকারবারিদের ঠেকাতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়নি। তারা কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তি রাজ্যগুলোকে সতর্ক করে দিতে। দিল্লি বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোকে বোঝাতে চায়, দেখো বাংলাদেশকে আমরা বন্দি করে রেখেছি। তোমরা স্বাধীন হতে চাইলে তোমাদেরকেও বন্দি করে রাখা হবে। বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক-কৃষক যারা দিল্লির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা কোনোভাবেই চোরাকারবারি হতে পারে না। কারণ সেই যোদ্ধারা জানে তাদের পণ্য-লেন দেনের ট্যক্সের টাকা লুটেই দিল্লির শাসকেরা অস্ত্র কিনবে। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং কয়েকটি টাকা বাঁচাবার জন্য বৈধ উপায়ে গরু বা অন্যান্য পণ্য লেন-দেন করে না। তারা জীবন বাঁচাতে একটু কাজ বা খাবারের জন্যই দুই দেশে যাতায়াত করে।

বাংলাদেশের জনগণের করণীয়: প্রথম করণীয়; দিল্লির সাম্রাজ্যবাদি, সম্প্রসারণবাদি, পুঁজিবাদি নেতৃত্ব, পুঁজিপতি ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপি জনমত তৈরি করা। দ্বিতীয় করণীয়; ভারতের জনযুদ্ধে জনগণের রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা এবং সেই দলের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। জনমত জনগণের পক্ষে আসলে দিল্লির ফ্যাসিবাদি নেতৃত্ব কাবু হতে বাধ্য। বাংলাদেশের জনগণের উচিত দিল্লির আগাসন, শোষণ ও ফ্যাসিবাদকে ঘৃণা করা। আর ভারতের শাসকদের অস্ত্র আমদানির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশে আন্দোলন গড়ে তোলা। তৃতীয় করণীয়; সিপিআই ও সিপিএমের সংশোধনবাদি নেতৃত্বের মুখোশ উন্মোচন করা। সেদেশে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারার বিপ্লবি দল গড়ে তোলা। ভারতে গণতন্ত্রের বিকাশে প্রতিনিয়ত সচেতন থাকলেই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। নতুবা, বাংলাদেশ তো পরাধিন হবেই, সংগে ভারতের সব জাতিকে পরাধীন হয়ে থাকতে হবে আরো বহু বছর।

তথ্যসূত্র:

১. সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭৮-৭৯
২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, ইউপিএল, ঢাকা; পৃষ্ঠা, ৩২৯।
৩. হায়দার আকবর খান জুনো, একাত্তরের রণাঙ্গন শিবপুর, সংহতি সংস্করণ, ঢাকা ডিসেম্বর ২০১১, পৃষ্ঠা ৭৮
৪. নিজস্ব প্রতিবেদক, ২০ জানুয়ারি ২০১৮, দৈনিক প্রথম আলো, অর্থনীতি সংবাদ, ” বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা ভারত চলে যাচ্ছে” https://www.prothomalo.com/economy/article/1413241/

রচনাকালঃ ১১ মে ২০১২

Leave a Comment

error: Content is protected !!