গণঅধিকারবাদ বা ‘চার্টিস্ট আন্দেলন’ বা চার্টার আন্দোলন (ইংরেজি: Chartism) হচ্ছে উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের গণঅধিকার অর্জনের ঐতিহাসিক একটি আন্দোলনের নাম। রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৮৩৮ এর গণঅধিকার অর্জন এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। জনসাধারণের দাবির অন্যতম ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টের নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশন আহবান, ব্যালটের মাধ্যমে ভোটপ্রদান, পার্লামেন্টের সদস্যদের ভাতা দান, নির্বাচনী এলাকাগুলির সম আকার, পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য বিশেষ পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি থাকার শর্ত বিলোপ।[১] গণঅধিকারবাদ বা চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয় ও ব্রায়েন, জি. জে হারল, আর্নেস্ট জোনস প্রমুখ শ্রমিক নেতাদের উদ্যোগে।[২]
উল্লেখিত বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের নেতারা ১৮৩৯ সনে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। এবং সে কনভেনশনে পার্লামেন্টে গণসহিসহ গণদরখাস্ত পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণসহি সংগ্রহ সরে সেই গণসহির স্তূপ বহন করে পার্লামেন্টে নিয়ে আসার চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিলে জনসাধারণের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। বার্মিংহামে এরূপ সংঘর্ষে ২৪ জন চার্টিষ্ট বা চার্টার আন্দোলনের কর্মী নিহত হয়। এই গণ আন্দোলন ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে।
১৮৩৯, ১৮৪২ এবং ১৮৪৮ সালে তিন দফায় গণসহিসহ গণদরখাস্ত পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। প্রতিবারই পূর্বের চেয়ে অধিকতর সংখ্যক সহি সংগৃহীত হতে থাকে। প্রথমে ১২ লক্ষ, দ্বিতীয় বারে ৩৩ লক্ষ এবং তৃতীয়বারে প্রায় ৫০ লক্ষ সহি সংগৃহীত হয়। এ সহির বোঝা এত বিরাট আকার এবং ভারী হয় যে ১৮৪২ সালে এই সহির বোঝা একটা বিরাট পাত্রে স্থাপন করে বিশজন আন্দোলনকারীকে বহন করতে হয়।
বস্তুত এত বিপুল আকারে সহি সংগ্রহ করার ঘটনা ইতিহাসে ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটে নি। সহি সংগ্রহ উপলক্ষে আন্দোলনকারীগণ সমাজের সমস্যাসমূহ নিয়ে যে সভা, আলোচনা ইত্যাদি সংগঠিত করে তাতে শ্রমিকসহ সমাজের নিচের তলার ব্যাপকতর মানুষ আলোড়িত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন শ্রমিকদের দ্বারাই পরিচালিত হয় এবং আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে একটি অভূতপূর্ব উপলব্ধির সৃষ্টি হয়। ১৮৪০ সনে চার্টিস্টরা একটি ঐক্যবদ্ধ চার্টিস্ট পার্টি তথা একটি শ্রমিক পার্টি গঠন করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করে এবং তা বিভিন্ন কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। গণঅধিকারবাদ বা চার্টিষ্ট আন্দোলন পুঁজিবাদী শাসনের সে যুগের ক্ষমতা ও অবস্থার পটভূমিতে বাহ্যত ব্যর্থ হলেও শ্রমজীবী মানুষের চেতনা সঞ্চারে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ইংল্যাণ্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন।
চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয় বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে। প্রধানত ১৭৯৯ সালে ব্রিটেন পার্লামেন্ট পত্রালাপ সমিতি সহ শ্রমিকদের যে কোন সংগঠন বেআইনী ঘোষণা করে। কার্যত ১৭৯৯- ১৮২৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ শ্রমিকদের কোন প্রকারের সভা, সমাবেশ, সংগঠন করার আইনী অধিকার ছিল না। ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে বুরবঁ শাসনতন্ত্রের অবসান হলে ইউরোপ জুড়ে শ্রমিক রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। কিন্তু ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রিফর্ম বিলে শ্রমিকদের জন্য আশাব্যাঞ্জক কিছু ছিল না।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০৮।
২. জাভেদ হুসেন সম্পাদিত, ডেমোক্রেটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য, সম্পাদকীয় পরিশিষ্ট, নাজমুল হাসান রাহাত অনূদিত, ব্রাত্যজন, কুমিল্লা, বাংলাদেশ ২০০৬
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।