নায়ক ঈনিয়াসের বিস্তর প্রশংসা। তা তিনি যোগ্য লোক ঠিকই জয়ধ্বনির। ট্রয়ের রাজবংশের শেষ প্রদীপ তিনি। যথার্থ বীর। বীরদের কারো থাকে দৈহিক শক্তি-সাহস, কারো থাকে বুদ্ধি-বিবেচনা। ঈনিয়াস শক্তি-সাহসে খাটো নন, বুদ্ধি-বিবেচনাতেও অনেক বড়ো। সর্বোপরি তার ছিল আনুগত্য—পরিবারের প্রতি ও জাতির প্রতি। নবজাতির স্রষ্টা তিনি, রোম সাম্রাজ্যের স্থপতি। ভার্জিলের মহাকাব্য ‘ঈনিদ’-এ সে-কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।
যেন মানুষ নন, জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। নইলে অত দায়িত্ব কীভাবে পালন করেন? ট্রয় যখন জ্বলছে, ছারখার হওয়ার অপেক্ষায়, তখন, সেই ভয়ঙ্কর রাতে, ঈনিয়াস শহরে নয়, ছিলেন শহরের বাইরে। রাত্রির আকাশ দেখেন জ্বলছে, শোনেন আর্তনাদ উঠেছে চতুর্দিকে। নগরের দিকে ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু নিবৃত্ত করেছেন দেবতারা। কেননা তারা জানতেন ঈনিয়াসের জন্য কর্তব্য সুনির্দিষ্ট আছে একাধিক। তিনি পিতাকে উদ্ধার করবেন, বাচাবেন স্ত্রী ও পুত্রকে, রক্ষা করবেন পারিবারিক দেবতাদের মূর্তিগুলোকে।
সাময়িকভাবে সব কর্তব্যই পালন করেছিলেন ঈনিয়াস। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পিতা ও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেন নি; তবে পুত্রকে বাঁচাতে পেরেছেন। কিন্তু আরো বড় কর্তব্য তো অপেক্ষায় ছিল এই রাজপুত্রের জন্য। সেটি হলো ট্রয়ের বংশধারাকে রক্ষা করা, সেই লক্ষ্যে নতুন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটানো। সে-কাজটি তিনি করেছেন। ভার্জিল তাঁর মহাকাব্যে অমর করে রেখেছেন জাতিগঠনের এই নায়ককে। যেন আদর্শপুরুষ একজন।
কিন্তু এই মহানায়ক মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন এক নারীর। সেই নারীর দুঃখের কথা ভার্জিলের মহাকাব্যে লেখা আছে; মহাকাব্যে বারটি খণ্ডের একটি পুরো খণ্ড ব্যয় করা হয়েছে ডিডোর জন্য, অন্য খণ্ডেও তিনি আছেন, তার আপন মহিমায়। কিন্তু যাই হোন, যতো গুণই থাকুক, থাক শোকের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ধারা, কোনো নারী তো নায়িকা হবেন না মহাকাব্যের, ডিডোও হন নি। নায়ক ঈনিয়াসই।
২.
শকুন্তলার সঙ্গে মিল রয়েছে ওই নারীর। ওই যে রাজা এলেন, প্রেম হলো বনবাসী নায়িকার সঙ্গে, তারপর রাজা চলে গেলেন রাজত্ব করতে, নায়িকাটি রয়ে গেলো বনে। ডিডোর কাহিনীও এ-রকমই।
কিন্তু আবার আলাদাও। ডিডো বনের কন্যা নন, রাজনন্দিনী। তিনি বনের তৃণলতা, পশুপাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন না, তাঁর জগৎ মানুষের জগৎ। এবং সেইখানে মহিয়সী তিনি, বিশেষভাবে। রাজার মেয়ে, পালিয়ে এসেছেন পিতৃরাজ্য থেকে। ভ্রাতার ভয়ে। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সিংহাসন পেয়েছেন, যেমনটা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভ্রাতা ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করেন নি, যেমনটা পাবেন বলে ডিডো আশা করেছিলেন।
ভ্রাতা যে তাঁর ভগ্নি ডিডোর প্রতি বিদ্বিষ্ট তা নয়। কিন্তু সে ব্যক্তি অত্যন্ত লোভী। লোভের তাড়নায় গোপনে হত্যা করেন ডিডোর স্বামীকে। ডিডোর স্বামী ছিলেন রাজ্যের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি। অর্থপ্রাচুর্যই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো, শেষ পর্যন্ত।
প্রথমে ডিডো জানতেন না যে ঘাতকটি আসলে কে। যখন জানলেন যে তার আপন ভাই করেছে ওই কাজ তখন মর্মাহত যেমন হলেন, তেমনি হলেন আতঙ্কিত। শোকাভিভূতা তরুণী বিধবা বুঝলেন ওই নগর তাঁর জন্য নিরাপদ নয়। বিলম্ব করেন নি। বন্দরে গিয়ে জাহাজ, নাবিক, সঙ্গী-সাথী যে কয়জন পেয়েছেন তাদেরকে নিয়েই পলায়ন করেছেন, নগর ছেড়ে। কোথায় যাচ্ছেন জানতেন না । ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত হলেন আফ্রিকার এক এলাকায়। সমুদ্রের কাছে বলেই জাহাজ ভেড়ানো গেলো সেখানে।
জায়গাটির নাম কার্থেজ। ডিডো এর রাজাহীন রানী হয়ে বসলেন। দেখা গেলো অসামান্য তার কর্মনিপুণতা ও নেতৃত্ববুদ্ধি। স্থানীয় মানুষদের নিজের পক্ষে নিয়ে এলেন টেনে। শুরু করলেন নগরনির্মাণ।
এই কার্থেজেই এসে উপস্থিত হয়েছেন ভাগ্যাহত রাজপুত্র, মহাবীর ঈনিয়াস। ডিডো দেখতে দেবীর মতো, আর ঈনিয়াস তো এফ্রোদিতির পুত্রই। তার পিতা মর্ত্যলোকের, মাতা দেবী। তাঁর চেহারা ও স্বাস্থ্যের তুলনা নেই।
কার্থেজে এসে ঈনিয়াস দেখেন এখানকার মানুষগুলো কেমন যেন বৈরী ভাবাপন্ন। তিনি জাহাজ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বিশটি; বারটি কোথায় গেছে সন্ধান নেই। ঝঞ্ঝা-বিধ্বস্ত ও হতোদ্যম সঙ্গীদের নিয়ে কার্থেজে এসে বুঝলেন লোকগুলো যেমন বৈরী তেমনি কর্মঠ। বিপুল কর্মোদ্যম চলছে চতুর্দিকে। শীতের শেষে গ্রীষ্ম এলে মৌমাছিরা যেমন ব্যস্ত হয়ে ওঠে ফুলের বনে, তেমনি ব্যস্ততা এখানকার মানুষের। কেউ তৈরি করছে উঁচু গম্বুজ, কেউ তৎপর মাটি খুঁড়তে; কাজ চলছে মঞ্চ তৈরির; রাস্তা পাকা করা হয়ে গেছে, দেয়াল উঠেছে যেখানে প্রয়োজন। সমস্ত কিছুর পেছনে রয়েছেন একজন। ডিডো। সবাই যাকে বলে এই রাজ্যের রানী।
বিধবা ডিডো স্বামীর শোকে কাতর। সেই সঙ্গে মগ্ন তিনি নগরনির্মাণে। আশপাশের রাজা ও রাজপুত্ররা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বিবাহের। তিনি প্রত্যাখান করেছেন, একের পর এক। ফলে শত্রু তাঁর চতুর্দিকে। আর সেজন্যই কার্থেজের মানুষ বিদেশীদের একেবারেই পছন্দ করে না, দেখলেই সন্দেহ করে, হাঁকিয়ে দেয়। ঈনিয়াস তা লক্ষ্য করছেন।
কিন্তু একি হলো ডিডোর, কেমন খেলা তাঁকে নিয়ে দেবদেবীদের, ঈনিয়াসকে দেখা মাত্র প্রেমে পড়লেন। ইচ্ছে হলো এঁকে তিনি বিয়ে করবেন। ধরে রাখবেন, আপন করে ।
তা কী করে বিয়ে করেন তিনি ঈনিয়াসকে? মান-সম্মান আছে। স্মৃতি রয়েছে স্বামীর। লোকে কী বলবে? ডিডোর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বড় বোন আন্না। আন্নাকে তিনি বলছেন নিজের অন্তর্জালার কথা। রাতে তার ঘুম হয় না, দিনে শান্তি পান না। এর চেয়ে ভালো ছিল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, পাতালে কিংবা আকাশে।
বোন আন্না বলেন, “তোর দুঃখটা আমি বুঝি বোন, তোর বিয়ে করা উচিত। তোর যৌবন কি নষ্ট হবে এভাবে? সন্তান থাকবে না? স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তুই আর কতদিন পড়ে রইবি, বোন? তাছাড়া আরো বিষয় আছে ভাববার। কার্থেজের নিরাপত্তার দিকটা রয়েছে। ঈনিয়াসকে বিয়ে করলে আমাদের ভয় কাটবে। শত্রুরা আর বিরক্ত করবে না। আমরা রক্ষা পাবো।”
ডিডো শোনেন। বোঝেন। কিন্তু ঠিক করতে পারেন না কী করবেন। এরি মধ্যে ঘটনা একটা ঘটে গেলো। রানী ডিডো সঙ্গী ও অতিথিদের নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলেন। মস্ত আয়োজন। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল; কিন্তু হঠাৎ উঠলো ঝড়, আর সেই সঙ্গে শুরু হলো বৃষ্টি। সে কী ঝড় আর বৃষ্টি, কিছু দেখা যায় না, দিনের বেলাতেই মনে হলো নেমে এসেছে গভীর রাত্রি। ঘোড়ায় করে ছুটছিলেন ডিডো ও ঈনিয়াস, এক সময়ে দেখেন দু’জনেই এসে আশ্রয় নিয়েছেন একটি গুহায়। আর কেউ নেই, কোথাও না। সেইখানে, সেই গুহার ভেতর তারা পরস্পরের অতি নিকটে গেলেন চলে। তারপর শান্ত হয়েছে প্রকৃতি, হেসে উঠেছে আকাশ। আকাশের তারা, চারপাশের গাছপালা—এদেরকে সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়ে গেলো ঈনিয়াসের সঙ্গে ডিডোর।
৩.
সুখে ছিলেন তাঁরা। কিন্তু ঈনিয়াস তো দায়িত্বপ্রাপ্ত নায়ক। তাঁর তো রয়েছে দেশপ্রেমিক কর্তব্য। তাকে হতে হবে নতুন একটি সাম্রাজের স্থপতি। এইখানে এই রাজ্যে রানীর অধীনস্থ হয়ে বসে থাকলে তার চলবে কেন? চৈতন্যের উদয় হলো তাঁর। আমি এ কী করছি? পরিণত হয়েছি রানীর কর্মসচিবে। তদারক করছি কাজের, রূপান্তরিত হয়ে গেছি অতিসাধারণ একটি স্বামীতে। আমার তো রয়েছে পিতৃমর্যাদা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, রয়েছে পুত্রের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ার কর্তব্য, আছে আমার রাজ্য গড়ার অঙ্গীকার।
বড় অস্থির ঠেকে ঈনিয়াসের। ভাবতে ভাবতে ঠিক করেন চলে যাবেন এই রাজ্য ছেড়ে। যাবেন নতুন দেশে। সেখানে প্রতিষ্ঠা করবেন নবীন রাজ্য। রানীকে বললে তিনি কান্নাকাটি করবেন, যেতে দেবেন না। তাই পালাবেন। গোপনে।
রানী ডিডো অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তিনি লক্ষ্য করছেন ঈনিয়াসের চাঞ্চল্য। বুঝতে পেরেছেন তাঁর উদ্দেশ্য। সরাসরি গিয়ে বললেন, ‘না, তোমার যাওয়া চলবে না। কেন যাবে, এখানে তোমার কিসের অভাব, কোনদিকে অসুবিধা?’
ঈনিয়াসকে বোঝান তিনি, কিন্তু কর্তব্য যাকে টানছে তাকে অন্য বিষয় বোঝাবেন কী করে? ডিডো দেখছেন, ঈনিয়াসের লোকেরা তৎপর। তারা জাহাজে খাদ্য ভরছে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিচ্ছে সংগ্রহ করে। পিপীলিকা যেমন কাজ করে নীরবে ও শৃঙ্খলায়, তেমনি কাজ চলছে ট্রয়ের লোকদের।
ডিডো আবার গেলেন। রাগ করলেন। কাঁদলেন। বললেন, ‘এখন ঝড়ের সময়, আর কিছুদিন অন্তত থেকে যাও।’ ঈনিয়াসের বুক কাঁপে, ঝড় উঠলে গাছ যেমন কেঁপে ওঠে তেমনিভাবে। কিন্তু তিনি শক্ত বৃক্ষ, কাঁপেন বটে, তবে কাত হন না।
শেষ পর্যন্ত গেলেন তিনি চলে।
ডিডোর শোকে এখন কোনো সান্ত্বনা নেই। চোখে তাঁর অবিরাম অশ্রুধারা।
ওদিকে রাগও জমেছে প্রচণ্ড। কোথা থেকে ভেসে এসেছিলে তোমরা। প্রার্থী ছিলে আশ্রয়ের। যদি বিমুখ হতাম, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে। আজ করছে বিশ্বাসঘাতকতা।
তাছাড়া লজ্জাও তো বটে। স্বামী-পরিত্যক্ত অবস্থায় কী করে তিনি মুখ দেখাবেন তার আপনজনকে। লোকলস্করকেও। হাসবে না? ধিক দেবে না? আর প্রতিবেশী রাজা ও রাজপুত্র, যাদেরকে তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন ঔদ্ধত্যে, তারাই বা কী বলবে?
ঈনিয়াস চলে গেছেন। ডিডো ঠিক করলেন তিনিও যাবেন চলে। আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু কাউকে জানতে দেন নি। একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে বললেন তিনি, কাঠের ওপরে কাঠ সাজিয়ে। উদ্দেশ্য, সেই আগুনে পোড়াবেন তিনি ঈনিয়াসের রেখে-যাওয়া যাবতীয় সামগ্রী—তার অস্ত্র, তার জামাকাপড়, তার ব্যবহৃত অন্য যা ছিল সবকিছু।
মস্ত আয়োজন করা হয়েছে আগুনের। শেষ মুহূর্তে রানী যা করলেন তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ঈনিয়াসের ফেলে-যাওয়া তলোয়ার দিয়ে বিদ্ধ করলেন নিজের হৃদয় এবং নিক্ষেপ করলেন নিজেকে ওই অগ্নিকুণ্ডে।
৪.
ঈনিয়াস গিয়ে পৌঁছেছেন আরেক দেশে। সামনে তাঁর নতুন জগৎ, নবীন কর্তব্য। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে রয়েছে যাবেন মৃতলোকে, গিয়ে দেখা করবেন তার মৃত পিতার সঙ্গে। সেখানে যাওয়াটা সামান্য ব্যাপার নয়। কোণে কোণে বাধা, পদে পদে বিপদ; তবু বীর ঈনিয়াস যাবেনই। এবং গেলেনও।
সেই মৃতলোকে সকলেই ছায়া ছায়া ও দূরবর্তী । কিন্তু অস্পষ্টতার ভেতরেও স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি পত্নী ডিডোকে। শরীরে অস্ত্রাঘাতের ভয়ঙ্কর ক্ষতগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। দেখে চমকে উঠেছেন। কাঁদতে শুরু করেছেন। যা আশঙ্কা করেছিলেন তা-ই তবে সত্য হয়েছে, আত্মহত্যা করেছে ডিডা।
বিলাপ করলেন ঈনিয়াস। বললেন, “আমার ভয় ছিল, তুমি মারাত্মক কিছু করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার উপায় ছিল না না-গিয়ে। আমার কাঁধে যে বোঝা তা নামিয়ে রাখবো এমন সাধ্য ছিল না আমার। আমি তোমার কাছে অপরাধী। আমার দুঃখ আমি কাকে বোঝাই?” বলে হাত বাড়িয়েছেন, ছোঁবেন বলে । কিন্তু ডিডো তখন বিষন্ন নন, ক্রুদ্ধ। প্রচণ্ড ক্রোধে তনি সরে গেলেন; চোখ তার নিচের দিকে নামানো, মূর্তিটি কঠিন, যেন পাথর কেটে বের-করা। তারপরে ঘৃণাভরে চলে গেছেন তিনি অন্ধকারের দিকে। সেখানে তার প্রথম স্বামী অপেক্ষা করছিলেন। ডিডো তাঁর প্রথম স্বামীকে আদর করলেন, হাত বুলিয়ে দিলেন গায়ে। ঈনিয়াস দেখলেন, অশ্রুসিক্ত দুই চোখে।
ডিডোর কাহিনীর এইখানেই শেষ। তিনি নায়িকা নন মহাকাব্যের। কালিদাস তাঁর শকুন্তলাকে নায়িকা করেছেন নাটকের, মহাকাব্য লিখতে গেলে কিন্তু পারতেন না সে স্থান তাঁকে দিতে। মহাকাব্যের মাপটা ভিন্ন রকমের। মহাকাব্য বীরত্ব চায়, যে-বীরত্ব নাটকীয় মুহূর্তে নায়িকাদের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু অধস্তনতার কারণে নায়িকাদের পক্ষে সম্ভব হয় না অন্যের জীবনকে তেমনভাবে প্রভাবিত করা যেমনভাবে নায়করা পারেন কাজটি করতে। ঈনিয়াস সাম্রাজ্য গড়েন, ডিডো গড়েন রাজ্য। ঈনিয়াস যুদ্ধ করেন, ডিডো করেন আত্মহত্যা। ঈনিয়াসের কাজ মহাকাব্যিক, ডিডোর কাজ ট্র্যাজিক।
কিন্তু ডিডোর আর্তধ্বনিটি রয়েছে। সেই দৃশ্য যেখানে তিনি আর্তনাদ করছেন না, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেটিও অনবদ্য। ভার্জিলের (৭০-১৯ খৃঃ পূঃ) পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে এই তরুণী বিধবার প্রতি। কিন্তু তিনি তাঁর শোকগাথা রচনার সময় পান না। ডিডো দ্বিতীয় স্থানেই রয়ে যান, প্রথম হন না। তাঁর এক স্বামী নিহত হন, অন্যস্বামী পলায়ন করেন। প্রথম আঘাতটা তবু সহ্য করেছিলেন, মন দিয়েছেলেন নগরনির্মাণে; কিন্তু দ্বিতীয় আঘাত ফিরিয়ে দেয়ার মতো অস্ত্র ছিল না কাছে। ভাই যাঁর বিশ্বাসঘাতক, স্বামী কাপুরুষ, তার জন্য সান্ত্বনার জায়গা কোথায়?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন গ্রন্থের এই লেখাটি নেয়া হয়েছে লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উক্ত বইয়ের ৫১-৫৫ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে। বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করে বিদ্যাপ্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০০-এ। অশোক পুস্তকালয়, এপ্রিল ২০১১, কলকাতা থেকে বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়। আমরা এই লেখাটি অশোক পুস্তকালয় প্রকাশিত সংস্করণ থেকে রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশ করেছি। গ্রন্থে প্রবন্ধটির নাম ছিল “তরুণী বিধবার পীড়িত হৃদয়”। বর্তমান শিরোনামটি রোদ্দুরের দেয়া।
“জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি” এবং “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য এবং প্রগতিশীল মার্কসবাদী আন্দোলনে প্রভূত অবদান রেখে এই লেখক এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। ২৩ জুন, ১৯৩৬ তারিখে জন্মগ্রহণ কারী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত।