বিশ্বধর্মসমূহের অন্যতম হচ্ছে ইসলাম বা ইসলামবাদ (ইংরেজি: Islam বা Islamism)। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের মধ্যে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের নাম উল্লেখযোগ্য। ইসলামের অনুসরণ দেখা যায় প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়া ভূখন্ডসমূহে। ইসলামের উদ্ভবকাল ৭ম শতাব্দী। আরব দেশের বিখ্যাত কোরাইশ বংশের আব্দুল্লাহর পুত্র হযরত মুহম্মদ কে (৫৭০-৬৩২ খ্রিঃ) ইসলামের অনুসারীগণ আল্লাহর আদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলে বিশ্বাস করেন এবং তাঁকে সম্মানের সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সা) বলে উল্লেখ করেন। হযরত মুহাম্মাদ ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।
ধর্মের দুটি দিক আছে। একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দিক। অপরটি সামাজিক দিক। ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে সাধারণ মানুষের এরূপ বিশ্বাস যে, দৃশ্য জগতের পিছনে একজন অদৃশ্য স্রষ্টা আছেন। তিনি মানুষকে সত্য পথে পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মানুষকে নির্বাচিত করেন। এক ধর্মের অনুসারীগণ অপর ধর্মের নির্বাচিত মানুষকে সাধারণত স্বীকার করতে চায় না।
ধর্মের উদ্ভব মানুষের রাষ্ট্রীয় সংগঠন সৃষ্টির পূর্বে ঘটেছে। ধর্ম শুধুমাত্র স্রষ্টার অস্তিত্বে ব্যক্তির বিশ্বাস নয়। সামাজিক জীবনযাপনের জন্য ধর্মের অনুশাসনসমূহও গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ধর্মের উদ্ভবের সঙ্গে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর সামাজিক প্রয়োজন জড়িত থাকে। আরবের গোত্রতান্ত্রিক সমাজের নতুনতর সামন্তবাদী সমাজে পরিবর্তিত হওয়ার ক্রান্তিকালে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটে। পূর্বে যেখানে আরবের অধিবাসীগণ বিভিন্ন সর্দার বা গোষ্ঠী নেতার অধীনে বিভিন্ন গোত্র বা বংশে বিভক্ত ছিল সেখানে এই প্রথম তাঁরা বিস্তৃতর অঞ্চলের একমাত্র নেতা ‘খলিফা’র অধীনে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হলো।
গোত্রতান্ত্রিক বিভাগে অর্থনৈতিক লেনদেন এবং যোগাযোগ যেখানে সংকীর্ণ ও তার বিকাশ অবরুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে খলিফার নেতৃত্বে সংগঠিত আরব ভূখন্ডে তা এবার অবাধ হয়ে উঠল। গোত্রের সংকীর্ণ পরিধিতে বিবদমান গোষ্ঠীসমূহকে এরূপ বৃহৎ একটি জনসংস্থায় সংগঠিত করার চিন্তানায়ক এবং সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেন হযরত মুহাম্মাদ। এই ভূমিকার মধ্যে তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অগ্রসর চিন্তার যে পরিচয় বিদ্যমান তা তাঁকে ইতিহাসে অন্যতম ধর্মীয় নেতা এবং সামাজিক সংগঠক হিসাবে স্মরণীয় করে রেখেছে।
ধর্মের তত্ত্ব ও সামাজিক বিকাশ এবং আচার অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে একই অঞ্চলে উদ্ভূত পূর্বের ইহুদী, খৃস্টান এবং জরাথুস্ট্র ধর্মের প্রভাব ইসলামের মধ্যে লক্ষ করা যায়। যে কোনো ধর্মতত্ত্বের মধ্যে একটি বিশ্বতত্ত্ব বা দর্শনের আভাস থাকে। ইসলামের দর্শন কোরান এবং হযরত মুহাম্মদের উপদেশাবলীর উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের প্রধান জোর আল্লাহর বিধান এবং সেই বিধান অনুযায়ী মানুষের ভাগ্য যে পূর্বনির্ধারিত এই তত্ত্বের উপর।
তাওক্কালাল্লাহু’ ‘আল্লাহর উপর নির্ভর কর’, ইসলামের অনুসারীদের জীবনের যে কোনো সংকটকালে এটি একটি সর্বদা উচ্চারিত বাণী। ‘আল্লাহর উপর নির্ভর কর এবং ধৈর্য্য ধারণ কর’ পরকালে পুরস্কার ও সুখ লাভ করবে-এরূপ উপদেশের উপর অত্যধিক জোরের মধ্যে মানুষকে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা ও সংকটে নিষ্ক্রিয় এবং অসহায় করে রাখার একটা প্রবণতা থাকে। আধুনিককালে প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে ইসলামের বিধানসমূহ যেরূপ নির্দিষ্ট, তেমনি অধিকতর অনড়।
ইসলামের ধর্মীয় বিধানসমূহের ব্যাখ্যা ভিত্তিতে তার বিভিন্ন ভাবধারা বিকাশ লাভ করেছে। এই ব্যাখ্যা যে দার্শনিকগণ অধিকতর উদারভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা মুতাজেলাবাদী বা মুক্তচিন্তাবাদী বলে পরিচিত। মুক্তচিন্তাবাদীরা প্রাচীন গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। তাঁরা প্লেটো এবং এরিস্টটলের দর্শন আরবী ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তীকালে এই অনুবাদের মাধ্যমেই ইউরোপ গ্রীক দর্শনের পরিচয় লাভ করে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৪০-২৪১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।