মৌরি (বৈজ্ঞানিক নাম: foeniculum-vulgare) শরীর শীতল করে তাই প্রাচীন কাল থেকেই মৌরির ব্যবহার মশলা আর মুখশুদ্ধি রূপে হয়ে আসছে। পান সাজবার সময়েও পানের ভেতর মৌরি দেওয়া হয়। মৌরি স্বাদে মিষ্টি বা মধুর। এই মধুরতা গুণের জন্যেই সংস্কৃত ভাষায় মৌরিকে মধুরী বলা হয় । চরকের মতে, মৌরি শূল প্রশমন করে বা কমিয়ে দেয়। সুশ্রুতের মতে কফ নাশ করে।
আয়ুর্বেদ মতে মৌরি শীতবীর্য (শীতল), রুচিকর, শুক্রবর্ধক, মুখদোষ নিবারক, রক্তপিত্ত, জ্বর, পেটের অসুখে, চোখের অসুখে ও শ্লেষ্ম রোগে উপকারী। যোনির ব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা (মল না হওয়া), অগ্নিমান্দ্য (খিদে না হওয়া), কৃমি, কাশি, বমি, শূল ও বায়ুনাশ করে, খাবার হজম করায় (পাচক)।
আরো পড়ুন: পানমৌরি এশিয়া জন্মানো জনপ্রিয় ভেষজ গুণসম্পন্ন মশলা
হকিমি মতে বক্ষঃস্থল (বুকের), যকৃৎ (লিভারের) প্লীহা ও মূত্রাশয়ের ক্লেদ নিঃসারণ করে। শীতের জন্যে যে ব্যথা হয় সেই ব্যথা ও বায়ু নাশ করে। শুক্র বৃদ্ধি করে। স্তন্যদুগ্ধ বৃদ্ধি করে। ঋতু ও প্রস্রাব পরিষ্কার করে।
মৌরি শাকের ক্বাথ রক্তশুদ্ধি ও গম্ভাশয় শুদ্ধির জন্যে যাঁরা সদ্য মা হয়েছেন তাঁদের খাওয়ানো হয়। হাকিমি মতে, মৌরি শাক গরম। হকিমি মতে মৌরি শাক চাক্ষষ্য-অথাৎ চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি করে।
অনেকের মতে মৌরি খিদে বাড়িয়ে দেয়, উত্তেজনা সৃষ্টি করে, বায়ু নাশ করে-পেট ফাঁপা ও শুল রোগে উপকার দেয়। মৌরি খেলে কাশির বেগ কমে। যাঁরা সদ্য মা হয়েছেন তাঁদের স্তনের দুগ্ধ স্রাব বেড়ে যায়।
সুস্থ থাকতে মৌরির প্রয়োগ:
১. পেটের অসুখে: মৌরি বেটে গুলিকন্ধের শুকনো (গোলাপের পাপড়ি চিনি দিয়ে পাক করা) পেটের ব্যথা সারে এবং পাকস্থলীর দূষিত বায়ু মাথায় উঠে যায় না (কথ্য ভাষায় মাথার বায়ু চড়ে যায় না)। ভাজা মৌরি বিশেষ করে বন্য মৌরি (কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়) পুরোনো পেটের অসুখ, নিউমোনিয়া ও শুল রোগের প্রশমন করে। মৌরির কাথ তৈরি করে খাওয়ালে বা মৌরি আর শুঁঠ (শুকনা আদা ঘিয়ে ভেজে মিহি করে চূর্ণ করে খেলে আম হজম হয়ে যায় এবং আশা ও আমমুক্ত পেটের অসুখ সেরে যায়।
২. চোখের রোগে: মৌরি পাতার রস চোখে দিলে চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি করে।
৩. পেটের গ্যাস বেরিয়ে যাওয়: মৌরি পাতা খেলে ঢেকুর উঠে দৃষিত গ্যাস বেরিয়ে যায় শ্লেষ্ম বিনষ্ট হয়, পাথরও বেরিয়ে যায়। মৌরি চিবিয়ে খেলে এবং তার রস গিলতে থাকলে পেটের ব্যথা ও গ্যাসের প্রকোপ কমে। মৌরির গুঁড়া অল্প পরিমাণ গরম জলে মিশিয়ে খেলে গ্যাসের প্রকোপ কমে।
৪. বমি কমাতে: মৌরির গুঁড়ায় ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে খেলে জ্বরের সময় যে বমিভাব হয় তা কমে যায় এবং পাকস্থলীর জ্বালা দূর হয়।
৫. খিদে বাড়াতে: গরমকালে অরুচি আর অখিদে হয়। তখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। মৌরির শরবত (জলে ভেজানো মৌরি-মিশ্রি দিয়ে) নিয়মিত খেলে এই অরুচি বা অখিদে ভাব দূর হয়।
৬. নব্য মায়েদের জন্য: যে সব মায়েরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়াচ্ছেন তাঁরা যদি নিয়মিত মৌরির শরবত (জলে ভেজানো মৌরি মিশ্রি দিয়ে) খান বাচ্চাদের আর পেটব্যাথা করবে না আর মায়েদের নের দুধও বৃদ্ধি পাবে।
৭. জ্বর সারাতে: মৌরির কাথে চিনি মিশিয়ে খেলে পিত জ্বরের প্রকোপ কমে। মৌরির আরক খাওয়ালে আম হজম হয়ে যায় এবং জ্বর ও পিপাসায় উপকার পাওয়া যায় ।
৮. কাশি কমাতে: মৌরির গুড়া আর চিনি মুখে রেখে বারবার মুখের রস গিলে ফেললে পেট গরমের জন্যে যে কাশি হয় তার বেগ বা প্রকোপ কমবে। মৌরির ছোট্ট পুঁটিলি বেঁধে জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এই জল রোগীকে খাওয়ালে রোগীর কাশিতে খুব উপকার হয়।
৯. বাচ্চাদের পেটের অসুখে: পুরোনো পেটের অসুখে ও পাকস্থলীর জ্বালায় মৌরি খেলে উপকার হয়। মিহি করে গুড়ো করে বাচ্চাদের পেটে মালিশ করলে পেট ব্যথা পেট ফোলা কমে।
১০. পেট পরিষ্কার: মৌরি বেটে গুলিকন্ধের শুকনো (গোলাপের পাপড়ি চিনি দিয়ে পাক করা) সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়।
মৌরির শরবত তৈরি করবার পদ্ধতি :
গরম কালে মৌরির শরবত পান করা উপকারী। গরমকালে শরীর ঠাণ্ডা রাখবার জন্যে মৌরির শরবত খাওয়া ভাল। ৫০০ গ্রাম মৌরি মিহি করে হামানদিস্তায় কুটে নিয়ে আধ লিটার জলে তিন চার ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। স্টিলের ডেকচিতে ভাল করে ফুটিয়ে নিয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে হেঁকে নিন।
এই জলে ৫০০ গ্রাম বা ৪০০ গ্রাম চিনি মিশিয়ে আবার ফুটিয়ে নিন। ঠাণ্ডা হলে বোতলে ভরে রাখুন। এই শরবত রোজ অল্প অল্প করে পান করলে গরমকালে শরীর ঠাণ্ডা হবে।
বাড়িতে স্বাদিষ্ট বিরেচণ চূর্ণ তৈরি করবার পদ্ধতি:
পেটের নানা রোগে এই চুর্ণ উপকার দেয়। এই চুর্ণ বাড়িতেই তৈরি করে রাখতে পারেন। মৌরি, যষ্টিমধু, আমলকীর খার, গন্ধক, প্রতিটি এক চা চামচ করে, সোনামুখী তিন চা চামচ, চিনি ছয় চা চামচ। প্রতিটি উপকরণ আলাদা আলাদা ভাবে কুটে চালুনি দিয়ে চেলে নিন। প্রথমে গন্ধক ও সোনামুখী চূর্ণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। এর পরে সব চুর্ণ এতে মিশিয়ে নিন ভাল করে। এই চুর্ণকেই স্বাদিষ্ট বিরেচন চুর্ণ বলা হয়। পরিষ্কার শুকনা শিশিতে ভরে রাখুন।
রোজ রাতেরে শোওয়ার সময় এক চা চামচ করে গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কিংবা শুকনা খাওয়ার পরে একটু গরম জল খেলে রক্তের দোষ, অর্শ, কোষ্ঠকাঠিন্য (পায়খানা না হওয়া), আমাশা, পেট গরম হওয়ায় উপকার হবে। সকালে পায়খানা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দ্রষ্টব্য : ১. সোনামুখী, আমলকীর খার, যষ্টিমধু গন্ধক ইত্যাদি সব উপকরণই কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়।
২. যদি এক চা চামচে কাজ না হয় অথাৎ কোষ্ঠ শুদ্ধি না হয় দেড় বা দু চা চামচও স্বাদিষ্ট বিরেচন চুর্ণ খেতে পারেন। বাড়িতে একবার কষ্ট করে বেশি পরিমাণে বিরেচন চূর্ণ তৈরি করে নিলে খেতে স্বাদযুক্ত হবে এবং বাজারের ভেজাল চূর্ণর চেয়ে অনেক বেশি উপকার দেবে।
মৌরির মুখশুদ্ধি বাড়িতে তৈরি করুন :
মৌরিতে নুন ও পাতিলেবুর রস মিশিয়ে বোতলে ভরে রাখুন। খাওয়া-দাওয়ার পরে খেলে উপকারও হবে মুখশুদ্ধি হিসেবে খেতে ভালও লাগবে। পান-জদার চেয়ে এটি হাজার গুণে নিদোষ, উপকারীও বটে।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২১৭-২২০।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Parvathisri
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।