প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নে বিপ্লবীদের কি কাজ করা উচিত?

জার্মান ‘বামপন্থীরা’ মনে করেন যে, তারা যতটা সংশ্লিষ্ট তাতে এই প্রশ্নে জবাবটা হল অকুণ্ঠ নেতিবাচক। তাঁদের মতে, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আর ‘প্রতিবৈপ্লবিক’ ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাঁকাল আক্রমণ এবং ক্রুদ্ধ জিগির (বিশেষভাবে ‘নিরেট’ এবং বিশেষত নির্বোধ ধরনের ক. হোর্নার যেমনটা বলেন) থেকেই যথেষ্ট ‘প্রমাণিত’ হচ্ছে যে লেগিনের ধরনের ইতর সোস্যাল শোভিনিস্ট, আপোষপন্থি এবং প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে বিপ্লবী এবং কমিউনিস্টদের কাজ করাটা অনাবশ্যক, এমনকি অমার্জনীয়।

এমন কর্মকৌশলের বৈপ্লবিকতা সম্বন্ধে জার্মান ‘বামেরা’ যতই দৃঢ়প্রত্যয়ী হন না কেন, সেটা প্রকৃতপক্ষে মূলত ভ্রান্ত, তাতে ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নেই।

এটা স্পষ্ট করে তোলার জন্য আমি শুরু করবো আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে, এই পুস্তিকাখানার সাধারণ পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে, সেটার লক্ষ্য হলো ইতিহাসে এবং বলশেভিকবাদের এখনকার দিনের কর্মকৌশলে যাকিছু আছে সর্বত্র সাধনযোগ্য, তাৎপর্যসম্পন্ন এবং প্রাসঙ্গিক সেটাকে পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা।

আজকের রাশিয়ার নেতৃবৃন্দ, পার্টি, শ্রেণি এবং জনসাধারণের মধ্যে সম্বন্ধ, আর তেমনি ট্রেড ইউনিয়নগুলির প্রতি প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব এবং প্রলেতারিয়েতের পার্টির মনোভাব স্পষ্ট-নির্দিষ্টভাবে নিম্নলিখিতরূপ: প্রলেতারিয়েতকে পরিচালিত করে বলশেভিকদের কমিউনিস্ট পার্টি- সর্বসাম্প্রতিক পার্টি কংগ্রেসের (২০ এপ্রিল, ১৯২০) উপাত্ত অনুসারে পার্টির সদস্যসংখ্যা ৬ লক্ষ ১১ হাজার। সদস্য সংখ্যা খুবই বদলেছে অক্টোবর বিপ্লবের আগে এবং পরেও, সেটা অনেকটা কম ছিল ১৯১৮ আর ১৯১৯ সাল অবধি। পার্টির বড় বেশি বৃদ্ধির ব্যাপারে আমরা শঙ্কিত হই, কেননা যারা শুধু গুলি খাবারই উপযুক্ত পাত্র এমনসব দাঁওসন্ধানী আর বুজরুকেরা শাসক পার্টির কাতারে কৌশলে ঢুকে পড়ার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, এটা অবশ্যম্ভাবী। পার্টির দ্বার আমরা শেষ বার অবারিত করেছিলাম- কেবল শ্রমিক আর কৃষকদের জন্য- সেটা হলো যখন (১৯১৯ সালের শীতকালে) ইউদেনিচ এসে পড়েছিল পেত্রগ্রাদ থেকে অল্প কয়েক ভার্সটের মধ্যে, আর দেনিকিন ছিল (মস্কো থেকে প্রায় ৩৫০ ভার্সট দূরে), অর্থাৎ যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ছিল মারাত্মকভাবে বিপন্ন, আর যখন ভাগ্যান্বেষী, দাঁওসন্ধানী, বুজরুক এবং সাধারণভাবে অবিশ্বস্ত লোকদের কমিউনিস্টদের সাথে শামিল হয়ে দাঁও মারতে পারবে বলে ভরসা করা সম্ভব ছিলো না (ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে এবং যন্ত্রণাভোগ করতে হবে বলে মনে করার কারণই ছিলো বেশি)। পার্টির কংগ্রেস হয় বছর বছর (সর্বসাম্প্রতিক কংগ্রেস হয়েছে প্রতি ১,০০০ সদস্য থেকে একজন করে প্রতিনিধির ভিত্তিতে), পার্টিকে পরিচালিত করে কংগ্রেসে নির্বাচিত ১৯ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি, আর মস্কোয় চলতি কাজ চালাতে হয় হয় সংগঠনি ব্যুরো এবং পলিটব্যুরো নামে পরিচালিত আরও ছোট ছোট সংস্থা দিয়ে, ব্যুরো দুটো নির্বাচিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনারি অধিবেশনে, প্রত্যেকটা ব্যুরোয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পাঁচজন করে। মনে হয় যেন এটা একটা পূর্ণাঙ্গ ‘অলিগার্কি’ [চক্রতন্ত্র]। আমাদের প্রজাতন্ত্রে কোনো রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেশ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কিংবা সাংগঠনিক প্রশ্নের মীমাংসা করে না।

পার্টি তার কাজে সরাসরি নির্ভর করে ট্রেড ইউনিয়নগুলির ওপর; শেষ কংগ্রেসের (এপ্রিল, ১৯২০) উপাত্ত অনুসারে সেগুলির সদস্য সংখ্যা ৪০ লক্ষর বেশি, আর সেগুলি যথারীতি নির্দলীয়। প্রকৃতপক্ষে, ইউনিয়গুলির বিপুল সংখ্যাগুরু অংশের সমস্ত পরিচালন সংস্থা এবং প্রথমত সারা রাশিয়ায় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বা ব্যুরো (সারা রাশিয়া কেন্দ্রীয় ট্রেড-ইউনিয়ন পরিষদ) তো বটেই গঠিত হয় কমিউনিস্টদের নিয়ে, আর সেগুলি পার্টির সমস্ত নির্দেশ কার্যে পরিণত করে। এইভাবে মোটের ওপর আমাদের রয়েছে যথাবিধি অ-কমিউনিস্ট, নমনীয়, অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত এবং খুবই শক্তিশালী প্রলেতারিয়ান বিধি-ব্যবস্থা (mechanism), যেটার মারফত পার্টি শ্রেণি এবং জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট, সেটার সাহায্যে শ্রেণিগত একনায়কত্ব খাটানো হয় পার্টির নেতৃত্বে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছাড়া, তাদের প্রবল সমর্থন আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছাড়া শুধু অর্থনীতির ব্যাপারে নয়, অধিকন্তু সামরিক ব্যাপারেও আড়াই বছর তো দূরের কথা আড়াই মাসও দেশ শাসন করা এবং একনায়কত্ব বজায় রাখা নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না আমাদের পক্ষে। চলিত কর্মক্ষেত্রে এই সব খুবই ঘনিষ্ঠ সংযোগের জন্য স্বভাবতই আবশ্যক হয় খুবই জটিল এবং বহুমুখী কাজ, সেটা প্রচার আর আলোড়নের আকারে, আর নেতৃস্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সঙ্গেই শুধু নয়, তার ওপর সাধারণভাবে প্রতিপত্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সঙ্গেও সময়োচিত এবং ঘনঘন সভা-সম্মেলনের আকারে; এইসব সংযোগের জন্য আবশ্যক হয় মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় সংগ্রাম, এদের এখনও কিছু কিছু অনুগামী আছে, যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম, মেনশেভিকরা তাদের শেখায় হরেক রকমের প্রতিবৈপ্লবিক ষড়যন্ত্র-কৌশল, সেগুলো হলো (বুর্জোয়া) গণতন্ত্রের প্রতি ভাবাদর্শগত সমর্থন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির স্বতন্ত্র (প্রলেতারিয়ান রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে স্বতন্ত্র!) হওয়া চাই এই মর্মে প্রচার থেকে শুরু করে প্রলেতারিয়ান শৃঙ্খলা বানচাল করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের বিবেচনায় ট্রেড ইউনিয়গুলির মারফত ‘জনগণের’ সঙ্গে সংযোগ যথেষ্ট নয়। আমাদের বিপ্লবের গতিপথে বাস্তব ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দেখা দিয়েছে নির্দলীয় শ্রমিক এবং কৃষক সম্মেলনের মতো প্রতিষ্ঠান, আর এই সব প্রতিষ্ঠানকে সর্বতোভাবে সমর্থন, বিকশিত এবং সম্প্রসারিত করতে আমরা সচেষ্ট থাকি, যাতে আমরা জনসাধারণের মেজাজ পর্যবেক্ষণ করতে পারি, তাদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারি, তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারি, তাদের মধ্যে যারা সেরা তাদের রাষ্ট্রীয় পদে উন্নীত করতে পারি, ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন-কমিসারিয়েতকে শ্রমিক কৃষকের পরিদর্শন সংস্থায় রূপান্তরিত করা সম্বন্ধে সাম্প্রতিক ডিক্রিতে এই রকমের নির্দলীয় সম্মেলনগুলিকে নানা রকমের তদন্ত চালাবার জন্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সদস্যদের বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি।

তবে কিনা পার্টির সমস্ত কাজই চালানো হয় সোভিয়েতগুলির মারফত, এগুলিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পেশা নির্বিশেষে মেহনতি জনসাধারণ। সোভিয়েতসমূহের জেলা  কংগ্রেসগুলো হলো এমন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বুর্জোয়া দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও যার মতো কখনো কিছু দেখেনি; এইসব কংগ্রেসের (সেগুলির কর্মপ্রবাহ খুবই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে পার্টি সচেষ্ট থাকে) মারফত, তেমনি গ্রাম এলাকাগুলিতে বিভিন্ন পদে শ্রেণি সচেতন শ্রমিকদের অবিরাম নিয়োগ করে প্রলেতারিয়েত কৃষককূলের নেতা হিসাবে নিজ ভূমিকা প্রয়োগ করে, শহুরে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব বলবৎ করে, প্রণালীবদ্ধ সংগ্রাম চালায় ধনী, বুর্জোয়া, শোষক এবং মুনাফাখোর কৃষকদের বিরুদ্ধে, ইত্যাদি।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক উপদল কাকে বলে

উপর থেকে একনায়কত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে দেখলে প্রলেতারিয়ান রাষ্ট্র ক্ষমতার যথাযথ বিধি-ব্যবস্থা (mechanism) এই রকমের। আমরা আশা করি পাঠক বুঝবেন যে-রুশি বলশেভিক এই বিধি-ব্যবস্থাটা জানে, পঁচিশ বছর ধরে এটাকে গড়ে উঠতে দেখেছে ছোট ছোট বেআইনি গুপ্ত চক্র থেকে, সে ‘উপর থেকে’ না, ‘নিচ থেকে’, নেতাদের একনায়কত্ব, না, জনগণের একনায়কত্ব, ইত্যাদি সম্বন্ধে এই সমস্ত কথাবার্তাকে হাস্যকর এবং শিশুসূলভ প্রলাপ বলে, মানুষের পক্ষে তার বাঁ পা, না, ডান হাত বেশি দরকারি তাই নিয়ে আলোচনার মতো একটা কিছু বলে মনে না করে পারে না কেন।

প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে কমিউনিস্টরা কাজ করতে পারে না, তা করা তাদের উচিত নয়, এমন কাজ প্রত্যাখ্যান করতে সমীচীন, ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে বেরিয়ে এসে খুবই খোশমেজাজি (আর বোধ হয় প্রধানত খুবই তরুণবয়স্ক) কমিউনিস্টদের উদ্ভাবিত আনকোরা এবং বিশুদ্ধ ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’ গড়া আবশ্যক, ইত্যাদি, ইত্যাদি মর্মে জার্মান বামদের জাঁকালো, মহা পান্ডিত্যপূর্ণ এবং ভয়াবহ বৈপ্লবিক আলোচনাকেও আমরা সমানই হাস্যকর এবং শিশুসূলভ বলে মনে না করে পারি না।

এটা অপরিহার্য যে, সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে উত্তরদান হিসেবে পুঁজিবাদ রেখে যায়, একদিকে, শ্রমিকদের মধ্যে সাবেকী বৃত্তি আর কারিগরির ভেদাভেদ, যা ক্রমে গড়ে উঠেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; আর অন্য দিকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি যা শুধু খুবই ধীরে, বহু বছরের পর বছরের কালক্রমে বিস্তৃততর শিল্পগত ইউনিয়নে পরিণত হতে পারে এবং তা হবে, (বিভিন্ন কারিগরি বৃত্তি আর পেশাই শুধু নয়, গোটা গোটা শিল্পজোড়া) এই সব ইউনিয়নে কারিগরি ইউনিয়নের ধাঁচ থাকবে কম, আর পরে এইসব শিল্পগত ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে চলে মানুষের মধ্যে শ্রমবিভাগ দূর করা যাবে, মানুষকে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া হবে, ঘটানো হবে তাদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ, আর সর্বাঙ্গীণ তালিম দেওয়া হবে তাদের, যাতে তারা করতে পারে সবকিছু। কমিউনিজম সেই লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে এবং এগোতে থাকবেই, সেখানে পৌঁছবেই কমিউনিজম, তবে শুধু বহু বহু বছর পরে। পূর্ণাঙ্গ, সম্পূর্ণরূপে সুস্থিত আর সুগঠিত সর্বাত্মক আর সুপরিণত কমিউনিজমের এই ভবিষ্য ফলটাকে এই চলতি কর্মে ফলাবার চেষ্টাটা চার বছরের শিশুকে উচ্চতর গণিত শেখাবার চেষ্টা করারই শামিল।

কোনো বির্মূত মানব উপাদান দিয়ে নয়, কিংবা আমাদের হাতে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা মানব উপাদান দিয়েও নয়, আমাদের জন্য পুঁজিবাদ রেখে গেছে যে মানব উপাদান তাই দিয়েই আমরা সমাজতন্ত্র গড়া শুরু করতে পারি (এবং করতে হবে)। একথা সত্য, এটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু এই কর্তব্যের প্রতি অন্য কোনো রূপ দৃষ্টিভঙ্গি এতোই কম গুরুত্ববহ যে তা দিয়ে আলোচনা করারই অবকাশ নেই।

পুঁজিবাদ বিকাশের গোড়ার দিকে ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে একটা মস্ত অগ্রপদক্ষেপ, কেননা তাতে সূচিত হলো শ্রমিকদের অনৈক্য আর অসহায় অবস্থা থেকে প্রাথমিক শ্রেণি সংগঠনের উত্তরণ। সবচেয়ে উন্নত আকারের প্রলেতারিয়ান শ্রেণি সংগঠন প্রলেতারিয়েতের বৈপ্লবিক পার্টি যখন নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকল (অর্থাৎ পার্টি তার নামের যোগ্যতাই অর্জন করবে না যে-পর্যন্ত তা নেতাদেরকে শ্রেণি ও জনগণের সাথে এক অবিচ্ছেদ্য সমগ্রতার মধ্যে আবদ্ধ করতে না শিখে) তখন- যা অবশ্যম্ভাবী- ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে প্রকাশ পেতে থাকলো কিছু কিছু প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান, কোনো কোনো বৃত্তিগত সঙ্কীর্ণতা, অরাজনীতিক হবার কোনো কোনো প্রবণতা, কিছুটা জড়তা ইত্যাদি। তবে ট্রেড ইউনিয়নগুলির মারফত ছাড়া, সেগুলি এবং শ্রমিক শ্রেণির পার্টির মধ্যে পরস্পর ক্রিয়ার সাহায্যে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পৃথিবীর কোথাও প্রলেতারিয়েতের বিকাশ চলেনি, তা চলতে পারে না। প্রলেতারিয়েতের রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করাটা হল শ্রেণি হিসেবে প্রলেতারিয়েতের একটা মস্ত অগ্রপদক্ষেপ; পার্টিকে আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে এবং শুধু পুরান ধরনে নয়, নতুন ধরনের ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে শিক্ষাদীক্ষা দিতে হবে এবং পরিচালিত করতে হবে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে সেগুলি হলো এবং দীর্ঘকাল যাবৎ থাকবে অপরিহার্য কমিউনিজম শিক্ষালয় এবং প্রলেতারিয়ানদের একনায়কত্ব খাটাতে তাদের তালিম দেবার প্রাথমিক শিক্ষালয়, শ্রমিক শ্রেণির কাছে (আলাদা আলাদা বৃত্তির কাছে নয়) এবং পরে সমগ্র মেহনতি জনগণের কাছে দেশের গোটা অর্থনৈতিক জীবনের ব্যবস্থাপনা ক্রমে হস্তান্তরিত করার জন্য শ্রমিকদের একটি অপরিহার্য সংগঠন।

উল্লেখিত অর্থে, ট্রেড ইউনিয়গুলির কিছুটা ‘প্রতিক্রিয়ান্বিত’ হওয়াটা প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের আমলে অনিবার্য। এটা উপলব্ধি না করলে বোঝায় পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মূল পরিবেশটা বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষমতা। এই প্রতিক্রিয়ান্বিত অবস্থাটাকে ভয় করা কিংবা এটাকে এড়িয়ে কিংবা ডিঙ্গিয়ে যাবার চেষ্টাটা হবে ঘোর মূঢ়তা কেননা তাতে বোঝাবে শ্রমিক শ্রেণি আর কৃষককূলের সবচেয়ে অনগ্রসর স্তরগুলি আর জনরাশিকে তালিম, শিক্ষাদীক্ষা আর জ্ঞান দেওয়া এবং নবজীবনে আকৃষ্ট করার প্রলেতারিয়ান সেনামুখের কাজটাকে ভয় করা। পক্ষান্তরে, যখন একজনও শ্রমিকের থাকবে না সঙ্কীর্ণমনা বৃত্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বৃত্তিগত আর বৃত্তিগত-ইউনিয়নী বদ্ধধারণা সেই সময় অবধি প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম করার কাজ মূলতবি রাখাটা হবে আরও গুরুতর ভ্রান্তি। প্রলেতারিয়েতের সেনামুখ ক্ষমতা হাতে নিতে কৃতকার্য হবে যখন ক্ষমতা দখলের সময়ে এবং পরে সেনামুখ কখন শ্রমিক শ্রেণি আর অপ্রলেতারিয়ান মেহনতি জনসাধারণের যথেষ্ট বিস্তৃত স্তরগুলির পর্যাপ্ত সমর্থন লাভ করতে পারবে, আর তারপর কখন সেটা মেহনতি জনগণের ক্রমাগত আরও বিস্তৃত জনরাশিকে শিক্ষাদীক্ষা আর তালিম দিয়ে এবং আকৃষ্ট করে শাসন বজায় রাখতে, পাকা-পোক্ত করতে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবে, তার পরিবেশ আর মুহূর্তটাকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করাই রাজনীতিবিদ্যা (এবং কোনো কমিউনিস্টের কাজগুলি সম্বন্ধে তার সঠিক উপলব্ধি)।

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয়েত অষ্টাদশ শতক পরবর্তীকালের শ্রমশক্তি বিক্রিকারী শ্রমিক শ্রেণি

অধিকন্তু, রাশিয়ার চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশসমূহে ট্রেড ইউনিয়নগুলির একটা কিছু প্রতিক্রিয়ান্বিত অবস্থা আমাদের দেশে যা তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণে প্রকাশ পেয়েছে, আর সেটা অবধারিতই ছিল। আমাদের মেনশেভিকরা ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে সমর্থন পেয়েছিল (অল্পসংখ্যক ইউনিয়নে কিছুটা সমর্থন তারা এখনও পায়)- এটা হলো ঐসব ইউনিয়নের বৃত্তিগত সঙ্কীর্ণতা, বৃত্তিগত স্বার্থপরতা আর সুবিধাবাদের ফল। ট্রেড ইউনিয়নে ঢের বেশি পাকা-পোক্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে পশ্চিমের মেনশেভিকরা; সেখানে সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তিসম্পন্ন আর সাম্রাজ্যবাদের উৎকোচে বশীভূত এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা কলূষিত বৃত্তিগত ইউনিয়নপন্থি, সঙ্কীর্ণচেতা, স্বার্থপর, নির্মম, লোভী, কূপমন্ডুক শ্রমিক অভিজাতকূল আমাদের দেশে যা তার চেয়ে ঢের বেশি প্রবল অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা অকাট্য। পশ্চিম ইউরোপে গম্পার্সদের বিরুদ্ধে এবং জুও, হেন্ডার্সন, মেরহেইম, লেগিন গির অ্যান্ড কোং-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামটা আমাদের মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেয়ে ঢের বেশি কঠিন- ওরা হলো একেবারেই সমধর্মী সামাজিক রাজনীতিক জাতের। এই সংগ্রাম হওয়া চাই ক্ষমাহীন, আর নিশ্চিতভাবেই সেটাকে তুলতে হবে এমন পর্যায়ে (যেমনটা আমরা করেছিলাম) যখন সুবিধাবাদ আর সোস্যাল শোভিনিজমের সমস্ত কট্টর নেতা একেবারেই অপদস্থ হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বিতাড়িত হয়। সংগ্রাম একটা নির্দিষ্ট পর্বে পৌঁছবার আগে রাজনীতিক ক্ষমতা দখল করা যায় না (এবং দখলের চেষ্টা করা চলে না) বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই নির্দিষ্ট পর্বটা হবে বিভিন্ন ; প্রত্যেকটা বিশেষ দেশে শুধু চিন্তাশীল, অভিজ্ঞ এবং ওয়াকিবহাল রাজনীতিক নেতারাই সেটা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারবেন। (রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে ২৫ অক্টোবর প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের অল্প কয়েকদিন পরে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে সংবিধান সভা নির্বাচন হলো এই সংগ্রামে সাফল্যের একটা মানদন্ড। এই নির্বাচনে মেনশেভিকরা পুরোদস্তর পরাস্ত হয়; তারা পেয়েছিল ৭ লক্ষ ভোট, ট্রান্সককেশাসের ভোট যোগ করলে- ১৪ লক্ষ, আর বলশেভিকরা পেয়েছিল ৯০ লক্ষ ভোট। ৭-৮ নং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক পত্রিকায় আমার সংবিধান সভা নির্বাচন এবং প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।)

শ্রমিক জনরাশির তরফে এবং তাদেরকে আমাদের পক্ষে আনার জন্যে আমরা সংগ্রাম চালাচ্ছি শ্রমিক অভিজাতকূলের বিরুদ্ধে; সুবিধাবাদী এবং সোশ্যাল-শোভিনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা আমরা চালাচ্ছি শ্রমিক শ্রেণিকে আমাদের পক্ষে আনার জন্যে। অতি প্রাথমিক এবং অতি স্বতঃপ্রতীয়মান এই সত্য ভুলে যাওয়াটা আজগুবি ব্যাপার। তবু এই উদ্ভট ব্যাপারটাই করে জার্মান বাম কমিউনিস্টরা, যখন ট্রেড ইউনিয়নের উপরতলার নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রতিবৈপ্লবিক প্রকৃতির দরুণ তারা ফট করে সিদ্ধান্ত করে বসে যে… ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে!! সেগুলোতে কাজ করতে নারাজ হতে হবে!! আমাদের গড়তে হবে নতুন এবং কৃত্রিম আকারের শ্রমিক সংগঠন!! এই সাঙ্ঘাতিক বোকামিটা এমনই অমার্জনীয় যাতে এটা হলো বুর্জোয়া শ্রেণির জন্যে কমিউনিস্টদের সবচেয়ে মস্ত সেবাকার্যেরই শামিল। যাবতীয় সুবিধাবাদী, সোশ্যাল-শোভিনিস্ট আর কাউটস্কিপন্থী ট্রেড-ইউনিয়ন নেতাদের মতো আমাদের মেনশেভিকরা শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়াদের দালাল ছাড়া কিছুই নয় (মেনশেভিকরা তাইই, যা আমরা বলেছি বরাবর), কিংবা পুঁজিপতি শ্রেণির শ্রমিক গোমস্তা মাত্র (Labour lieutenants of the capitalist class), এতে প্রয়োগ করলাম আমেরিকায় ড্যানিয়েল দে লিওঁর অনুগামীদের অতি চমৎকার এবং প্রাগাঢ় সত্য কথাটা। প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে কাজ করতে নারাজ হবার অর্থ হলো ঊন-পরিণত বা অনগ্রসর শ্রমিক জনরাশিকে ছেড়ে দেওয়া প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের, বুর্জোয়াদের দালালদের, শ্রমিক অভিজাতদের, কিংবা ‘যেসব শ্রমিক একেবারেই বুর্জোয়া বনে গেছে’ (তুলনা করুন, ব্রিটিশ শ্রমিকদের সম্বন্ধে ১৮৫৮ সালে মার্কসের কাছে এঙ্গেলসের চিঠি) তাদের প্রভাবাধীনে।

প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়গুলোতে কমিউনিস্টদের কাজ করা উচিত নয়, এই মর্মে হাস্যকর তত্ত্বটায় যারপরনেই স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে ‘জনসাধারণের’ উপর প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে ‘বাম’ কমিউনিস্টদের চপল মনোভাব এবং ‘জনসাধারণ’ সম্বন্ধে সোরগোল নিয়ে তাদের অপব্যবহার। ‘জনসাধারণকে’ কেউ সাহায্য করতে চাইলে এবং ‘জনসাধারণের’ সহানুভূতি আর সমর্থন লাভ করতে চাইলে তার ভয় করা চলে না বাধা-বিঘ্ন কিংবা নেতাদের তরফ থেকে ‘খোঁচাখুঁচি’, ছল চাতুরী, অপমান আর নির্যাতন (সুবিধাবাদী এবং সোশ্যাল-শোভিনিস্ট ঐসব নেতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি কিংবা পরোক্ষে বুর্জোয়াদের এবং পুলিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট), যেখানেই জনগণ আছে অবশ্যই সেখানেই কাজ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে, সমিতিতে আর সংঘে- সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হলেও- প্রলেতারিয়ান কিংবা আধা-প্রলেতারিয়ান জনরাশিকে দেখা যায় সেগুলিতে প্রণালীবদ্বধভাবে, অধ্যাবসায়ী হয়ে, অটল থেকে এবং ধৈর্যসহকারে আলোড়ন আর প্রচার চালাবার জন্যে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে, সবচেয়ে মস্ত মস্ত প্রতিবন্ধ অতিক্রম করতে পারতে হবে তাকে। ট্রেড ইউনিয়ন আর শ্রমিক সমবায় সমিতিতে (পরেররটায় অন্তত কখনও কখনও) ঠিক এইসব সংগঠনেই দেখা যায় জনসাধারণকে। সুইডেনের Folkets dagblad politoken (ফোলকেটস ডাগব্লাড পলিটিকেন) পত্রিকার ১৯২০ সালের ১০ মার্চের সংখ্যায় উদ্ধৃত উপাত্ত অনুসারে, ব্রিটেনে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা ১৯১৭ সালের শেষ দিকে ছিলো ৫৫ লক্ষ, সেটা বেড়ে ১৯১৮ সালের শেষে ৬৬ লক্ষ- ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি। ১৯১৯ সালের শেষের দিকে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় মোটামুটি ৭৫ লক্ষ। ফ্রান্স আর জার্মানি সম্বন্ধে অনুরূপ উপাত্ত আমার হাতে নেই, তবে একবারেই অকাট্য এবং সর্বজনবিদিত তথ্য থেকে নিশ্চিত দেখা যায় ট্রেড ইউনিয়নে সদস্যসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে এই দুই দেশেও।

এইসব তথ্য একটা জিনিসকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে তুলেছে, যেটা প্রতিপন্ন হচ্ছে হাজারো অন্যান্য লক্ষণ থেকে— যেমন, প্রলেতারিয়ান জনরাশির মধ্যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে, অনগ্রসর অংশগুলির মধ্যে শ্রেণি চেতনা এবং সংগঠন কামনা বাড়ছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আর জার্মানিতে নিযুত নিযুত শ্রমিকের কোনো সংগঠন ছিলো না, তারা সেই অবস্থা থেকে এই প্রথম এগিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক, নিম্নতম, সবচেয়ে সহজ-সরল এবং (যা এখনও নানা বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বদ্ধধারণায় একবারেই ভরপুর) সবচেয়ে সহজে বোধগম্য আকারের সংগঠনে, অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়নে; অথচ বিপ্লবী কিন্তু অপরিণামদর্শী ‘বাম’ কমিউনিস্টরা হাত গুটিয়ে থেকে ‘জনসাধারণ’ ‘জনসাধারণ’! জিগির ছাড়ে, কিন্তু সেগুলো প্রতিক্রিয়াশীল (!!) এই বাজে অজুহাত দেখিয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে কাজ করতে অস্বীকার করে!! উদ্ভাবন করে আনকোরা, বিশুদ্ধ খুদে ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’ যা বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বদ্ধধারণার দোষমুক্ত এবং বৃত্তিগত সঙ্কীর্ণমনা বৃত্তিগত-ইউনিয়নী পাপ বর্জিত যে ইউনিয়ন- তারা জোর গলায় বলে- হবে (হবে !) বিস্তৃত সংগঠন। ‘সোভিয়েত ব্যবস্থা এবং একনায়কত্ব মান্যই হবে সদস্যতার একমাত্র শর্ত’ !! (উল্লিখিত রচনাংশ দ্রষ্ট্রব্য)।

আরো পড়ুন:  শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে

‘বাম’ বিপ্লবীরা যা করছে তার চেয়ে অনুপযুক্ত কিছু কিংবা বিপ্লবের পক্ষে অধিকতর হানিকর কিছু কল্পনা করা কঠিন! রাশিয়া আর আঁতাঁতের বুর্জোয়াদের ওপর আড়াই বছরের অভূতপূর্ব বিজয়গুলির পরে আজ রাশিয়ায় আমরা যদি একনায়কত্ব মেনে নেওয়াকে করতাম ট্রেড ইউনিয়নে সদস্যতার একটা শর্ত সেটা তো হত আমাদের খুবই নির্বুদ্ধিতার কাজ, তাতে আমরা জনসাধারণের মধ্যে আমাদের প্রভাবটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতাম, আর আনুকূল্য করতাম মেনশেভিকদের। কমিউনিস্টদের ওপর যে কাজ বর্তাচ্ছে সেটা হলো অনগ্রসর অংশগুলির প্রত্যয় জন্মানো, তাদের মধ্যে কাজ করা, সেটা নয় কৃত্রিম এবং বালসুলভ ‘বাম’ স্লোগান দিয়ে তাদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, গমপের্স, হেন্দারসন, জুও, এবং মহাশয়রা এসব ‘বামপন্থী’ বিপ্লবীদের নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, যারা জার্মান ‘নীতিগত’ বিরোধী পক্ষের (এরূপ ‘নীতিবাগিশতা’ থেকে ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন) মতো কিংবা ‘মার্কিন বিশ্ব শিল্প শ্রমিকদের কিছুসংখ্যক বিপ্লবীদের মতো প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়ন পরিত্যাগ ও তাতে কাজ করতে অস্বীকার করার কথা প্রচার করে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই যে, কমিউনিস্টদের ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রাখার জন্য, ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে তাদের কাজকে যথাসম্ভব কষ্টকর করে তোলার জন্য, আর তাদেরকে অপমানিত, প্রলুব্ধ ও নির্যাতন করার জন্য, এসব ভদ্রলোকেরা, এসব সুবিধাবাদী ‘নেতারা’ বুর্জোয়া কূটনীতির সবরকম চালাকির আশ্রয় নেবেন এবং বুর্জোয়া সরকার, পুরোহিত ও পুলিশের সাহায্য নেবেন। এই সব কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, আর যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এমনকি নানা রকমের কলাকৌশল, ফন্দি ফিকির ও বেআইনি কায়দার, এড়িয়ে যাওয়ার এবং কৌশলে পরিহার করার আশ্রয় নিতে হবে, যাতে ট্রেড ইউনিয়নে ঢুকে পড়া যায়, সেগুলোতে অবস্থান করা যায় এবং যেকোনো ভাবেই হোক সেগুলোর ভেতরে কমিউনিস্ট কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া যায়। জারতন্ত্রের আমলে ১৯০৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রকার ‘বৈধ সুযোগসুবিধা’ ছিলো না। কিন্তু গুপ্ত পুলিশের চর জুবাতভ যখন বিপ্লবীদের ফাঁদে ফেলবার ও তাদেরকে মোকাবেলা করবার উদ্দেশ্যে ‘কৃষ্ণ শতক শ্রমিক পরিষদ’ ও ‘শ্রমিক সমিতি’ সংগঠিত করলো, তখন আমরা আমাদের পার্টি সভ্যদের এসব পরিষদ এবং এসব সমিতিতে পাঠালাম (তাঁদেরই একজনের কথা আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে আছে; তিনি ছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গের একজন নেতৃস্থানীয় ফ্যাক্টরি শ্রমিক, কমরেড বাবুশকিন; ১৯০৬ সালে জারের জেনারেলরা তাঁকে গুলি করে মারে)। তাঁরা শ্রমিক জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন, আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হন, এবং জুবাতভের দালালদের প্রভাব থেকে শ্রমিকদের বের করে আনতে সফলকাম হন। যে পশ্চিম ইউরোপ হলও অত্যন্ত গভিরে প্রোথিত আইনানুগতা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন, সেখানে অবশ্যই এধরনের কাজ চালানো অধিক বিপত্তিময়। যাই হোক, তবুও এ কাজ চালানো যায় এবং অবশ্যই চালাতে হবে, আর চালাতে হবে পরিপূর্ণভাবে।

আমি মনে করি, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নির্বাহী কমিটির সুস্পষ্টভাবেই নিন্দা করা উচিত, সাধারণভাবে, প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করতে অস্বীকার করার কর্মনীতিকে (কেন এরূপ অস্বীকৃতি অবিবেচনাপ্রসূত, আর তা প্রলেতারিয় বিপ্লবের কর্তব্যের কী রকম চূড়ান্ত ক্ষতি করে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেই), আর বিশেষভাবে, হল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির কিছু সদস্যের আচরণ ধারাকে, যারা এই ভ্রান্ত কর্মনীতি সমর্থন করেছেন_ তা সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, প্রকাশ্য বা গোপন, সামগ্রিক বা আংশিক, যেভাবেই হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না; আর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পরবর্তী কংগ্রেসকেও তা নিন্দা করার আহ্বান জানানো। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অবশ্যই উচিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের রণকৌশলের সাথে বিচ্ছেদ ঘটানো; তার অবশ্যই উচিত নয় বিতর্কের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা ধামাচাপা দেওয়া, বরং উচিত খোলাখুলি আকারে সেগুলো উপস্থাপন করা। পুরো সত্য কথাটা সোজাসুজিই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টদের’ (জার্মানির ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি) সামনে উপস্থিত করা হয়েছে; অনুরূপভাবে, ‘বাম’ কমিউনিস্টদের সামনেও পুরো সত্যটি স্পষ্টভাবে অবশ্যই উপস্থিত করতে হবে।

বি দ্রঃ প্রবন্ধটি লেনিনের ‘”বামপন্থী’ কমিউনিজম শিশুসুলভ ব্যাধি” বই থেকে সংকলিত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!