আমাদের তলোয়ার দু’টি, লেনিন ও স্তালিন

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেস সম্পর্কে আমি দু-চার কথা বলতে চাই। আমি মনে করি, আমাদের তলোয়ার দু’টি- লেনিন ও স্তালিন। রুশরা এখন স্তালিন-তলোয়ারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। হাঙ্গেরিতে গোমুলকাসহ আরো কিছু ব্যক্তি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে তা দিয়েই রাশিয়াকে বিদ্ধ করতে চাইছে, এবং তথাকথিত স্তালিনবাদের বিরোধিতা করছে। বেশ কিছু ইউরোপিয় দেশের কমিউনিস্ট পার্টিও সোভিয়েত ইউনিয়নের, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোগলিয়াত্তি। সাম্রাজ্যবাদীরাও জনগণকে কোতল করতে এই তলোয়ারটি ব্যবহার করছে। যেমন ডালেস* এখন এই তলোয়ারই ঘোরাচ্ছেন। এই তলোয়ার কেউ কাউকে ধার দেয়নি, একে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা চিনারা তা ছুঁড়ে ফেলে দেইনি। প্রথমত, আমরা স্তালিনের মর্যাদা রক্ষা করছি, দ্বিতীয়ত, একই সংগে তাঁর ত্রুটি বিচ্যুতির সমালোচনা করছি। ‘সর্বহারা একনায়কত্বের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে’ নামে একটি প্রবন্ধ আমরা লিখেছি। অন্যরা যেমন স্তালিনবিরোধী কুৎসা করে তাঁকে নস্যাৎ করতে চেয়েছে আমরা তা করিনি। আমরা বাস্তব অনুসারে ক্রিয়া করেছি। আর লেনিন নামক তলোয়ারটি? তাঁকেও কি কিছু সোভিয়েত নেতা বহুলাংশে ছুঁড়ে ফেলেন নি? আমার মতে, তারা লেনিনকেও বহুলাংশে ছুঁড়ে ফেলেছেন। অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য কি আজও প্রাসঙ্গিক? আজও কি সকল দেশের সামনে তা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে? ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে বিংশতি কংগ্রেসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি বলছে, সংসদীয় রাস্তায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যায়। অর্থাৎ, দুনিয়ার সকল দেশের আর অক্টোবর বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার দরকার নেই। একবার এই ধারনার দরজা খুলে দেয়া মানে সব মিলিয়ে লেনিনবাদকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।

আমাদের সম্বল কী? আমাদের সম্বল লেনিন ও স্তালিন। তোমরা এখন স্তালিনকে খারিজ করেছ এবং বাস্তবে লেনিনকেও সম্পূর্ণ বাতিল— জমি থেকে লেনিনকে তোমরা উপড়ে ফেলেছ, হয়ত এখনও হাতে মাথা কাটনি, হয়ত তাঁর একটা হাত কেটে ফেলেছ। আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং অক্টোবর বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টা ধরে রেখেছি। মার্কস তাঁর রচনায় আমাদের জন্য বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার রেখে গিয়েছেন, লেনিনও তা-ই। জনগণের ওপর আস্থা রাখা, মাস লাইন অনুসরণ করার শিক্ষা আমরা তাঁদের থেকে পেয়েছি। শ্রেণিসংগ্রাম পরিচালনার সময়ে জনগণের উপর আস্থা না রাখা বা জনগণ ও শত্রুদের আলাদা করে চিনতে না পারাটা খুবই বিপদজনক।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দল কী, কাকে বলে ও কেন প্রয়োজন
লেনিন ও স্তালিন আমাদের তলোয়ার — মাও সেতুং

বিগত কয়েক বছরে দুনিয়ার ওপর দিয়ে বহু ঝড় বয়ে গিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি বিংশতি কংগ্রেসে স্তালিনের ওপর বড় আক্রমণ হেনেছে। এর পরপরই সাম্রাজ্যবাদীরা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে দুদফায় আক্রমণ চালিয়েছে। বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনে দুবার বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এই ঝড়ের আঘাতে ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু কমিউনিস্ট পার্টির বড় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর তত ক্ষতি হয়নি। কিছু লোকজন যারা স্তালিনকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন, বিংশতি কংগ্রেসে তাঁরাই স্তালিনের প্রবল বিরোধী হয়ে দেখা দিলেন। আমার মতে এই সব লোকেরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অনুসরণ করে চলে না, কোনো বিষয়কে সর্বদিক থেকে খুঁটিয়ে বিচার করে না, তাঁদের বিপ্লবী নৈতিকতায় ঘাটতি আছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বহারার বিপ্লবী নৈতিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেহেতু আগে তোমরা স্তালিনের সপক্ষে ছিলে, এখন একেবারে সম্পূর্ণ বিরোধী হয়ে যাওয়ার সপক্ষে কিছু যুক্তি তো তোমাদের দেয়া উচিত। কিন্তু হটাত ভোল বদলাবার পিছনে কোনো যুক্তি তোমরা দিচ্ছ না, যেন জীবনে তোমরা কোনোদিন স্তালিনের পক্ষে দাঁড়াওনি, যদিও সত্য হলও ইতিপূর্বে তোমরা পুরোপুরি স্তালিনকে সমর্থন করেছিলে। স্তালিন মূল্যায়নের প্রশ্নটা গোটা বিশ্বের সাম্যবাদী আন্দোলনের বিষয়, সকল দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তার অংশীদার।

প্রসঙ্গত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সংগে আমাদের মতপার্থক্যের বিষয়টি বলে যাই। প্রথমত স্তালিনের মূল্যায়ন নিয়ে ক্রুশ্চেভ ও আমাদের মধ্যে বিরোধ আছে। স্তালিনকে যেভাবে তিনি কালিমালিপ্ত করেছেন আমরা তাতে সায় দিতে পারি না। তিনি স্তালিনকে অত্যন্ত কুৎসিতভাবে চিহ্নিত করেছেন অথচ স্তালিনের মূল্যায়ন এককভাবে কেবল তাঁর দেশের বিষয় নয়। এটা সকল দেশের বিষয়। আমরা তিয়েন-আন-মিন স্কোয়ারে স্তালিনের ছবি রেখেছি যা গোটা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের আকাঙ্ক্ষার সংগে সংগতিপূর্ণ। এটা ক্রুশ্চেভের সংগে আমাদের মৌলিক পার্থক্যকেই সূচিত করে।

১৫ নভেম্বর, ১৯৫৬;

অষ্টম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় প্লেনারি অধিবেশনের বক্তব্য থেকে;

মাও সেতুং রচনাবলী, ৫ম খণ্ড।

টিকাঃ * সিআইএ’র ডিরেক্টর জন ফস্টার ডালেস।

আরো পড়ুন:  কার্ল মার্কস ও নিউ রাইনিশ গেজেট

Leave a Comment

error: Content is protected !!