ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত জ্ঞানগর্ভ পুস্তিকা কমিউনিজমের নীতিমালা

প্রশ্ন-১. কমিউনিজম কি?

উত্তর: কমিউনিজম হলো প্রলেতারিয়েতের মুক্তির পদ্ধতি সংক্রান্ত মতবাদ।

প্রশ্ন-২. প্রলেতারিয়েত কি?

উত্তর: প্রলেতারিয়েত হলো সমাজের সেই শ্রেণি যে শ্রেণির সদস্যরা সম্পূর্ণ জীবিকার সংস্থান করে কেবল শ্রমশক্তি বিক্রি করে, কোনো রকমের পুঁজির মুনাফা দ্বারা নয়। প্রলেতারিয়েত তাঁদের নিয়েই গঠিত যাদের সুখ-দুঃখ, যাদের জীবন-মৃত্যু, যাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব নির্ভর করে শ্রমশক্তির চাহিদার উপর — অর্থাৎ ব্যবসায়ের উঠতি-পড়তির পালা বদলের দ্বারা সৃষ্ট অবস্থার উপর, নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতার খেয়ালখুশির উপর। এককথায় প্রলেতারিয়েত বা প্রলেতারিয়ানদের শ্রেণি হলো উনিশ শতকের শ্রমিক শ্রেণি।

প্রশ্ন-৩. তাহলে কি প্রলেতারিয়ানেরা সকল সময় ছিলো না?

উত্তর: না। গরিব জনসাধারণ এবং শ্রমিক শ্রেণিসমূহ সব সময়ই ছিলো। শ্রমিক শ্রেণিসমূহ প্রায়শই ছিলো গরিব। কিন্তু শ্রমিক এবং গরিব জনসাধারণ সকল সময়ই ঠিক উপরে বর্ণিত অবস্থায় ছিলো না। অন্য কথায়, সকল সময় এ-রকম অবাধ এবং নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতা যেমন ছিলো না তেমনি প্রলেতারিয়ানেরাও সব সময় ছিলো না।

প্রশ্ন-৪. প্রলেতারিয়েতের উদ্ভব হলো কীভাবে?

উত্তর গত শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডে উদ্ভূত হয়েছিলো শিল্প বিপ্লব, তার পর থেকে সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে পৃথিবীর সমস্ত দেশে — সেই শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রলেতারিয়েতের উদ্ভব।

স্টিম ইঞ্জিন, বিভিন্ন সুতা-কাটার যন্ত্র, যান্ত্ৰিক তাঁত এবং বহুসংখ্যক অন্যান্য কল-কব্জা উদ্ভাবনের ফলে ঘটেছিল এই শিল্প-বিপ্লব। এইসব যন্ত্রপাতি ছিল খুবই ব্যয়বহল, কাজেই সেগুলো কিনতে পারত কেবল বড় বড় পুঁজিপতিরাই, সেগুলো তদবধি বর্তমান সমগ্র উৎপাদন-প্ৰণালীটোকে বদলে দিল এবং তদবধি বর্তমান শ্রমিকেরা যা করত তার চেয়ে সস্তা আর সরেস পণ্য উৎপন্ন হলো যন্ত্ৰে ! এইভাবে এইসব যন্ত্র প্রচলনের ফলে শিল্প পুরোপুরি চলে গেল বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে, শ্রমিকদের সামান্য সম্পত্তি (হাতিয়ার, হাতে চালান তাঁত, ইত্যাদি) হয়ে পড়ল অকেজো, এইভাবে অচিরেই পুঁজিপতিরা হয়ে গেল সবকিছুর মালিক, শ্রমিকদের হাতে থাকল না কিছু।

এইভাবে বোনা জিনিস উৎপাদনের ক্ষেত্রে চালু হয়েছিল কারখানা প্রণালী ; – যন্ত্রপাতি প্রবর্তন করায় এবং কারখানা প্রণালীতে যেই বেগ সঞ্চারিত হলো অমনি কারখানা প্রণালী দ্রুত ঢুকে পড়ল অন্যান্য সমস্ত শাখায়, বিশেষত কাপড় বোনা আর বই-ছাপার বৃত্তিতে, মৃৎশিল্পে এবং লোহালক্কড় শিল্পে।

আরো পড়ুন:  কার্ল মার্কসের জীবন

কাজ ক্রমেই আরও বেশি বেশি করে ভাগ-ভাগ হয়ে পড়তে থাকল বহু শ্রমিকের মধ্যে, তাতে যে-শ্ৰমিক আগে তৈরি করত গোটা জিনিসটা সে পয়দা করতে থাকল জিনিসটার একটা অংশ। এই শ্রমবিভাগের ফলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত এবং কাজেই অপেক্ষাকৃত সস্তায় জাতদ্রবোর যোগান সম্ভব হয়ে উঠল। এর ফলে প্রত্যেকটি শ্রমিকের কাজ খুবই সরল, অনবরত পুনরাবৃত্ত যান্ত্রিক ক্রিয়াপ্রণালিতে পরিণত হলো, তাতে কাজটা যন্ত্র করতে পারে সমানই ভালোভাবেই শুধু নয়, ঢের বেশি ভালভাবেই! এইভাবে, ঠিক সুতা-কাটা আর ধাপড়-বোনা শিল্পেরই মতো শিল্পের ঐ সমস্ত শাখা একটার পরে একটা গড়ে গেল স্টীম-শক্তি, যন্ত্রপাতি আর কারখানা প্রণালীর দখলে।

কিন্তু ঐ সমস্ত শিল্প বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেল তার ফলে, আর এক্ষেত্রেও শ্রমিকদের স্বাধীনতার লেশমাত্রও অবশিস্ট রইল না। যথার্থ ম্যানুফ্যাকচার ছাড়াও তেমনিভাবে হস্তশিল্প ও ক্রমাগত বেশি পরিমাণে চলে গে। কারখানা প্রণালীর দখলে, কেননা এক্ষেত্রেও বড় বড় পুঁজিপতিরা বড় বড় কর্মশালা বসিয়ে খুদে মালিকদের ক্রমাগত বেশি পরিমাণে ঠেলে দিয়েছিল একধারে। ঐসব কর্মশালায় অনেকটা সাশ্রয় হত, আর কাজও সুবিধাজনকভাবে ভাগ করে দেওয়া যেত শ্রমিকদের মধ্যে।

এইভাবে অবস্থাটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে সমস্ত সভ্য দেশে শ্রমের প্রায় সমস্ত শাখায়ই কাজ চলে কারখানা প্রণালীতে, এগুলির প্রায় সমস্ত শাখায় হস্তশিল্প আর ম্যানুফ্যাকচারকে উচ্ছেদ করেছে বৃহদায়তনের শিল্প। — ফলে, আগেকার মধ্যশ্রেণীগুলি, বিশেষত অপেক্ষাকৃত খুদে মালিক হস্তশিল্পীরা ক্রমেই অধিকতর পরিমাণে জেরবার হয়ে গেছে, শ্রমিকদের আগেকার অবস্থান বদলে গেছে একেবারেই, আর দেখা দিয়েছে দুটো নতুন শ্রেণী, যারা অন্যান্য সমস্ত শ্রেণীকে ক্ৰমে ক্রমে আত্মভূত করছে, এই শ্রেণী-দুটো হলো:

এক। বড় বড় পুঁজিপতিদের শ্রেণী; সেটা সমস্ত সভ্য দেশে ইতোমধ্যে প্রায় সমগ্রভাবেই সমস্ত জীবনোপায়ের এবং এইসব জীবনোপায় উৎপাদনের জন্যে আবশ্যক কাঁচামাল আর সাধিত্রের (যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, ইত্যাদির মালিক) এটা হলো বুর্জোয়া শ্রেণী বা বুর্জোয়ারা (bourgeoisie)

দুই। সেই শ্রেণীটা যারা একেবারে কিছুরই মালিক নয়, যারা কাজেকাজেই বুর্জোয়াদের কাছে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য সেটার বিনিময়ে অত্যাবশ্যক জীবনোপায় জোটাবার জন্যে। এই শ্রেণীটাকে বলা হয় প্রলেতারিয়ান শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েত।

আরো পড়ুন:  শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির উদ্বোধনী ভাষণ
প্রশ্ন-৫: বুর্জোয়াদের কাছে প্রলেতারিয়ানদের এই শ্রম-বেচা চলে কোন পরিবেশে?

উত্তর: অন্য যেকোন পণ্যের মতো শ্রমও একটা পণ্য; অন্য যেকোন পণ্যের মতো একই নিয়মে এটার দাম স্থির হয়। আমরা পরে দেখতে পাব বৃহদায়তনের শিল্প আর অবাধ প্রতিযোগিতা বলতে বোঝায় একই জিনিস — এটার কিংবা ওটার দখলে পণ্যের গড় দাম সবসময়েই পণ্যটির উৎপাদন পরিব্যয়ের সমান। শ্রমিকটি যাতে লুপ্ত হয়ে না যায়, সেজন্যে যে পরিমাণ জীবনোপায় আবশ্যক সেটাই শ্রম উৎপাদনের পরিব্যায়। এইভাবে, ঐজন্যে যা আবশ্যক তার চেয়ে বেশি শ্রমিক পাবে না তার শ্রম বাবত; জীবিকানির্বাহের জন্যে অবশ্যক সবচেয়ে কম, ন্যুনকল্প পরিমাণ হবে শ্রমের দাম বা মজুরি। যেহেতু ব্যবসাবাণিজ্য চলে কখনও একটু মন্দ, কখনও একটু ভাল, তাই শ্রমিক পায় কখনও একটু বেশি, কখনও একটু কম, ঠিক যেমন কারখানার মালিক তার পণ্য বাবত পায় কখনও একটু বেশি, কখনও একটু কম। কিন্তু ঠিক যেমন, দিনকাল ভালই হোক আর খারাপই হোক, কারখানা মালিক তার পণ্য বাবত গড়ে পায় সেটার উৎপাদন পরিব্যয়ের চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়, তেমনি শ্রমিকও গড়ে পাবে সেই ন্যুনকল্প পরিমাণের চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়। শ্রমের সমস্ত শাখা যত বেশি পরিমাণে চলে যাবে বৃহদায়তনের শিল্পের হাতে ততই বেশি কড়াকড়ি করে প্রযুক্ত হতে থাকবে মজুরি সংক্রান্ত এই আর্থনীতিক নিয়ম।

প্রশ্ন-৬: শিল্প-বিপ্লবের আগে কোন কোন মেহনতী শ্রেণি ছিল?

উত্তর: সমাজের বিকাশের বিভিন্ন পর্ব অনুসারে মেহনতী শ্রেণীগুলির জীবনযাত্রার পরিবেশ ছিল বিভিন্ন, আর মনিব এবং শাসক শ্রেণিগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পক ছিল বিভিন্ন। প্রাচীনকালে মেহনতী জনগণ ছিল তাদের মালিকদের দাস, ঠিক যেমনটা এখনও তারা রয়েছে অনেক অনগ্রসর দেশে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশেও। মধ্যযুগে তারা ছিল ভূস্বামী অভিজাতকুলের মালিকানাধীন ভূমিদাস, ঠিক যেমনটা তারা এখনও রয়েছে হাঙ্গেরিতে, পোল্যান্ডে আর রাশিয়ায়। মধ্যযুগে এবং শিল্প-বিপ্লব অবধি আরও ছিল পেটি-বুর্জোয়া মনিবদের কাজে নিযুক্ত হস্তশিল্পীরা, আর ম্যানুফাকচারের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ৰমে ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিকদের উদ্ভব ঘটেছিল, এখন তাদের খাটায় কমবেশি বড় বড় পুঁজিপতিরা।

আরো পড়ুন:  প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নে বিপ্লবীদের কি কাজ করা উচিত?
প্রশ্ন-৭: দাস থেকে প্রলেতারিয়ানের পার্থক্যটা কোন দিক থেকে?

উত্তর: দাস বিকিয়ে যায় সরাসরি পুরোপুরি, প্রলেতারিয়ান বিকোয় দিনে-দিনে, ঘন্টায়-ঘণ্টায়। প্রত্যেকটি ব্যক্তি-দাস কোনো একক মালিকের সম্পত্তি—আর কিছু না হলেও অন্তত মালিকের স্বার্থের খাতিরে এই দাসের জীবনোপায় নিশ্চিত থাকে, সেটা যত অকিঞ্চিৎকরই হোক; ব্যক্তি প্রলেতারিয়ান যেন গোটা বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্পত্তি, যখন কারও প্রয়োজন হয় কেবল তখনই তার শ্রম কেনা হয়, তার জীবনোপায়ের কোন নিশ্চয়তা নেই। জীবনোপায় নিশ্চিত থাকে শুধু সমগ্রভাবে প্রলেতারিয়ান শ্রেণীর জন্যে। দাস থাকে প্রতিযোগিতার বাইরে, প্রলেতারিয়ানের অবস্থান সেটার ভিতরে। সেটার যাবতীয় ওঠা-পড়া তাকে মালুম করতে হয়। নাগরিক সমাজের একজন সদস্য হিসেবে নয়। — দাস গণ্য হয় জিনিস হিসেবে; লোক হিসেবে, নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে ধরা হয় প্রলেতারিয়ানকে। এইভাবে, দাসের জীবনযাত্রা প্রলেতারিয়ানের চেয়ে ভাল হতে পারে, কিন্তু প্রলেতারিয়ান হলো সমাজ বিকাশের একটা উচ্চতর পর্বের মানুষ, তার অবস্থান দাসের চেয়ে উপরের স্তরে। কেবল দাসপ্রথার সম্পর্ক ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে দাস মুক্তি লাভ করে, এবং সেইভাবে নিজে হয়ে যায় প্রলেতারিয়ান; প্রলেতারিয়ান মুক্তি লাভ করতে পারে শুধু, সাধারণভাবে সমগ্র ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!