ফের্দিনান্দ লাসালে বা ফের্দিনান্দ জোহান গটলিয়েব লাসালে (ইংরেজি: Ferdinand Johann Gottlieb Lassalle; (১১ এপ্রিল ১৮২৫ – ৩১ আগস্ট ১৮৬৪) ছিলেন একজন জার্মান বিচারক, দার্শনিক, এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মী। তাঁকে যদিও জার্মানিতে আন্তর্জাতিক ধাঁচের সমাজতন্ত্রের প্রবর্তনকারী হিসেবে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়, তিনি ছিলেন মূলত পেটি বুর্জোয়া সুবিধাবাদী। তিনি ইয়ং-হেগেলিয়ান হিসাবেই মার্কসের সাথে পরিচিত। ১৮৬৩ সনে জার্মানির প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন তিনি। এর নাম হয় জেনারেল ইউনিয়ন অফ জার্মান ওয়ার্কার্স বা সাধারণ জার্মান শ্রমিক সংগঠন। লাসালে যখন ১৮৬৩ সালের ২৩ মে সাধারণ জার্মান শ্রমিক সংগঠন গঠনের উদ্যোগ নেন, জার্মানিতে মার্কসের অনুসারীরা তাতে যোগদান করেননি। তিনি প্রথম জার্মান শ্রমিক দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন, ১৮৬৩ সালের ২৩ মে ১৮৬৪ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর পর্যন্ত এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে আইন মেনে সমান, সর্বজনীন এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়।
তিনি মার্কসের প্রতি সশ্রদ্ধ ছিলেন। পুঁজি গ্রন্থ লেখার জন্য তিনি মার্কসকে উৎসাহিত করেন। মার্কস এবং বিশেষ করে এঙ্গেলস লাসালেকে পছন্দ করতেন না। লাসালে ছিলেন বিলাসী, খেয়ালী ও দাম্ভিক। তিনি বুর্জোয়াদের সমালোচনা করেন, ভূস্বামীদের নয়।[১]
১৮৬৩ সালের ১১ মে অটো ভন বিসমার্ক, প্রুশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মন্ত্রী, লাসালের সংগে যোগাযোগের উদ্যোগ নেন। ১৯২৭ সালে বিসমার্ক-লাসালে যোগাযোগের কাহিনি আবিষ্কৃত হয় এবং এই কারণে তার আগের জীবনীভিত্তিক লেখায় এটি উঠে আসেনি। বিসমার্ক একটি হাতে লিখিত রচনা লাসালের কাছে পাঠান এবং দুজনে পরে ৪৮ ঘণ্টা মুখোমুখি আলোচনা করেন[২] এই আলোচনাসমূহ বিসমার্ক এবং লাসালের মধ্যে সাধারণ বিষয়সমূহে স্বাধীনভাবে মতামতসমূহের আদানপ্রদানের প্রমাণ তুলে ধরে।
১৮৭৫ সালে অগাস্ট বেবেল এবং উইলিয়ম লিয়েবলেক্ট সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে লাসালে থেকে পৃথকভাবে চলার চেষ্টা করেন। কিন্তু লাসালের নেতৃত্বেই গোথা কর্মসূচি তৈরি হয়। কার্ল মার্কস এই কর্মসূচির সমালোচনা করে লেখেন ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’। এই লেখায় লাসালের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনা সত্ত্বেও এটি বর্জিত হয় না। যদিও লাসালে কমিউনিস্ট লীগের একজন সদস্য ছিলেন, তার রাজনীতিতে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের কঠোর বিরোধিতা ছিল। মার্কস এবং এঙ্গেলস মনে করতেন যে লাসালে একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট ছিলেন না, কারণ তিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বিসমার্কের সরকারকে সর্বজনীন পুরুষদের ভোটাধিকারের জন্য সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন।[৩]
লাসালে শ্রমিকদের সমবায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রীকরণে আস্থাশীল ছিলেন।[৪] লাসালে বলেছেন ‘সমস্ত সম্পদ এবং সব সংস্কৃতির উৎস হচ্ছে শ্রম’। তাঁর সময়ে প্রধানতম রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি ও তাঁর অনুগামীবৃন্দ সুবিধাবাদী মনোভাব দেখান এবং সেজন্য মার্কস ও এঙ্গেলস তীব্র সমালোচনা করেন।[৫]
কার্ল মার্কস এবং তাঁর অনুসারিগণ মনে করেন যে রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল শ্রেণি সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য একটি শ্রেণিভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামো এবং ভবিষ্যতের শ্রেণিহীন সমাজে এটি ‘শুকিয়ে মরবে’। কিন্তু মার্কসবাদীদের বিপরীতে লাসালে রাষ্ট্র সম্পর্কে এই ধারনাটি বর্জন করেন, বিপরীতে তিনি বিবেচনা করতেন যে রাষ্ট্র একটি স্বাধীন সত্তা, সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি অর্জনের জন্য একটি আবশ্যকীয় ন্যায়পরায়ণ যন্ত্র।[৬]
তথ্যসূত্র ও টিকা:
১. সমীরণ মজুমদার; মার্কসবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ১৬০-৬১।
২. Footman, David (1994), The Primrose Path: A Biography of Ferdinand Lassalle, London: Cresset Press, Page-175.
৩. Rohan Butler, The Roots of National Socialism, 1783-1933 (London: Faber and Faber, 1941), p. 134.
৪. সমীরণ মজুমদার; মার্কসবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, বৈশাখ, ১৪০২, পৃষ্ঠা ১৬০-৬১।
৫. মার্কস এঙ্গেলস, মার্কস এঙ্গেলস রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ; প্রগতি প্রকাশন ,মস্কো; ১৯৭২; পৃষ্ঠা- ৩৫৭।
৬. Berlau, A Joseph (1949), The German Social Democratic Party, 1914–1921, New York: Columbia University Press, pp. 21–22.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।