সমর শিল্প বুর্জোয়ার শ্রেণিগত আধিপত্য সুদৃঢ়করণ ও সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের শক্তি

সমর শিল্প বা সামরিক শিল্প (ইংরেজি: Arms Industry) বা সামরিক শিল্পের একত্রীকরণ হচ্ছে বৃহত সামরিক শিল্পের অগ্রাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিক চক্রগুলোর সমরবাদী মিলন, যারা একচেটিয়া বুর্জোয়ার শ্রেণিগত আধিপত্য সুদৃঢ়করণ ও তা বিস্তারের স্বার্থে সামরিক শক্তির অবিরত বিকাশের পক্ষপাতী। সামরিক শিল্প মালিকরা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদি ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও আক্রমণাত্মক অংশ।[১]

সমর শিল্প অস্ত্র এবং সামরিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি তৈরির বৈশ্বিক ব্যবসা। এটি বাণিজ্যিক শিল্প নিয়ে গঠিত যেটি গবেষণা, উন্নতি, উৎপাদন এবং সামরিক উপকরণ, যন্ত্রপাতি ও সুবিধাসমূহের সেবার সাথে সংযুক্ত থাকে। অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিসমূহকে প্রতিরক্ষা ঠিকাদার (defense contractors) বা সামরিক শিল্পের সাথে নির্দেশ করা হয়। অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিসমূহ প্রধানত রাষ্ট্রসমূহের অস্ত্র শক্তির জন্য অস্ত্র উৎপাদন করে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলো সমর শিল্প চালায়; অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্র ক্রয় বিক্রয় করে। আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, মিসাইল, সামরিক বিমান, সামরিক যানবাহন, জাহাজ, বৈদ্যুতিক সিস্টেম ইত্যাদি উৎপন্নদ্রব্য সমর শিল্পের ক্রয় বিক্রয়ের এখতিয়ারে থাকে। সমর শিল্প আরো পরিচালনা করে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও উন্নয়ন এবং সামরিক বাহিনীর মালপত্রের সরবরাহ বণ্টন ও বদলি এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড প্রদান করে। 

সামরিক শিল্প সমাহার অনেক সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে। এর কারণ, সামরিক উৎপাদন সামরিক শিল্প কর্পোরেশনগুলোকে প্রচুর মুনাফা দেয়, এ মুনাফার হার বেসামরিক সেক্টরে প্রাপ্ত হারের চেয়ে অনেক বেশি।

স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউট বা SIPRI অনুযায়ী, ২০১০-১৪ সালে প্রধান অস্ত্রের আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের পরিমাণ ছিল ২০০৫-২০০৯ সালের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। ২০১০-২০১৪ সালে পাঁচটি বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জার্মানি ও ফ্রান্স এবং উক্ত সময়ে পাঁচটি বৃহত্তম অস্ত্র আমদানীকারক দেশ ছিল ভারত, সৌদি আরব, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পাকিস্তান।[২]

পৃথিবীর বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেটের তালিকায় থাকা প্রথম দশটি দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ভারত, সৌদি আরব, জার্মানি ও ব্রাজিল যাদের ২০১১ সালের টাকার পরিমাণ ১.২৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা পৃথিবীর মোট খরচের ৭৪ ভাগ। এই দশটি দেশ প্রতিরক্ষা বাজেটের সর্বাধিক ব্যয় করে থাকে। এই তথ্য পাওয়া গেছে স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে।[৩] একই সময় ২০১১ সালে পৃথিবীর মোট খরচ ১.৭৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে ব্রাজিলের পরিবর্তে দক্ষিণ কোরিয়া উক্ত তালিকায় ঢুকে যায়। এছাড়াও ২০১৬ সালে বিশ্বের মোট সামরিক খরচ হচ্ছে ১৬৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।[৪]

আরো পড়ুন:  রাশিয়া এবং তার পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের প্রতি আবেদন --- স্তালিন ও লেনিন

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসীরা গত কয়েক বছরে উগ্র জাতিদম্ভ ও বর্ণবাদকে স্লোগান হিসাবে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছে এবং সেই উদ্দেশ্যেই সেখানে প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতায় বসানো হয়। এর একটিই লক্ষ্য যুদ্ধপ্রস্তুতি শুধু দ্রুততর করা নয়; যে কোন সময়ে যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই আগ্রাসন বা যুদ্ধ করার পথ খোলা রাখা। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে চলেছে।

অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী ও সন্ত্রাসবাদী দেশগুলোও নিজেদের স্বার্থে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে চলেছে। গোটা বিশ্বেই সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের রণনীতির স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দালাল রাষ্ট্রসমূহ সাম্রাজ্যবাদী মদতে বৃদ্ধি করে চলেছে যুদ্ধ প্রস্তুতি। এ প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাজেটের চিত্রে দেখা যায় যেমন, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট সত্তর হাজার দুইশত পঞ্চাশ (৭০,২৫০) কোটি ডলার, চীন ২০,৭৬০ কোটি ডলার, ভারত ৬,২১০ কোটি, ব্রিটেন ৫,৮৪০ কোটি, রাশিয়া ৫,১৬০ কোটি, সৌদি আরব ৫,৬০০ কোটি, ফ্রান্স ৫,৩৬০ কোটি, জাপান ৪,৫১০ কোটি, জার্মান ৪,৪৫০ কোটি, দক্ষিণ কোরিয়া ৩,৯১০ কোটি, অস্ট্রেলিয়া ৩,২০০ কোটি, ব্রাজিল ২,৯০০ কোটি, ইতালি ২,৭২০ কোটি, ইউএই ২,১৪০ কোটি, ইরান ১,৭৪০ কোটি, কানাডা ১,৬১০ কোটি, ইসরাইল ১,৬০০ কোটি, স্পেন ১,৫৩০ কোটি এবং তাইওয়ান ১,৪৫০ কোটি ডলার। এভাবেই বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের কৌশলগত দালাল রাষ্ট্রগুলো সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে ক্রমাগত যুদ্ধের দামামা চাঙ্গা করে চলেছে।[৫]

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৮৪।
২. Sipri. “Trends in International Arms Transfer, 2014.” Www.sipri.org., Stockholm International Peace Research Institute, 2014, books.sipri.org/product_info?c_product_id=495.
৩. স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউট, ইংরেজিতে এটির নাম Stockholm International Peace Research Institute. ওয়েবসাইট: www.sipri.org. প্রতি বছর এখান থেকে সংঘাত, অস্ত্রসজ্জা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে গবেষণা ও তথ্য প্রদান করা হয়। ২০১১ সালের তথ্য পাওয়া গেছে এই ইউআরএল থেকে: http://www.sipri.org/research/armaments/milex/resultoutput/milex_15/the-15-countries-with-the-highest-military-expenditure-in-2011-table/view.
৪. SIPRI Fact Sheet,April 2017, “Trends in World Military Expenditure, 2016” (PDF). Stockholm International Peace Research Institute. Retrieved 23 March 2018. url: https://www.sipri.org/sites/default/files/Trends-world-military-expenditure-2016.pdf.
৫. আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, সাপ্তাহিক সেবা, ৩৮ বর্ষ  সংখ্যা ০৯, রবিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ঢাকা।

আরো পড়ুন:  ফোকো তত্ত্ব বিদ্রোহের উদ্দেশ্যে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বাহিনী দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়ণ করে

Leave a Comment

error: Content is protected !!