ভারতে অভ্যুত্থান

লন্ডন ১৭ জুলাই ১৮৫৭

দিল্লি বিদ্রোহী সিপাহীদের হস্তগত ও মোগল বাদশাহ ঘোষিত হবার পর ৮ই জুন ঠিক এক মাস হলো। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের এই প্রাচীন রাজধানী বিদ্রোহীরা দখলে রাখতে পারবে তেমন কোনো ধারণা অবশ্যই অস্বাভাবিক। দিল্লি সুরক্ষিত কেবল একটি দেয়াল ও একটি সাধারণ পরিখা দিয়ে, আর দিল্লির চারিপাশে ও দিল্লিকে শাসনে রাখার মতো টিলা পাহাড়গুলি ইতিমধ্যেই ইংরেজদের দখলে, তারা দেয়াল না ভেঙেই জল সরবরাহ কেটে দেবার মতো সহজ পদ্ধতিতেই স্বল্প সময়ে দিল্লিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে। তাছাড়া বিদ্রোহী সৈন্যদের যে একটা এলোমেলো দঙ্গল স্বীয় অফিসারদের খুন করে শৃঙ্খলার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেনাপত্য অর্পণ করার মতো কাউকে খুঁজে পায়নি, তারা নিশ্চয় এমন একটা দল, যাদের কাছ থেকে গুরুতর ও দীর্ঘায়ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আশা সবচেয়ে কম। বিভ্রান্তি আরও পাকিয়ে তোলার জন্য বাংলা প্রেসিডেন্সির সর্বাঞ্চল থেকে নতুন নতুন বিদ্রোহী বাহিনী এসে অবরুদ্ধ দিল্লি সৈন্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়াচ্ছে, যেন একটা স্থিরীকৃত পরিকল্পনা অনুসারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এই মৃত্যুদণ্ডিত নগরে। দেয়ালের বাইরে ৩০ ও ৩১ মে তারিখের যে দুটি অভিযানের ঝুঁকি নেয় বিদ্রোহীরা এবং গুরুতর ক্ষতিতে যা প্রতিহত করে, তার উদ্ভব যেন আত্মনির্ভরতা বা শক্তির মনোভাব থেকে নয়, বরং মরিয়াপনা থেকে। একমাত্র অবাক লাগে শুধু ব্রিটিশের আক্রমণগুলির ধীরতায়— কিছুটা পরিমাণে যদিও তা ব্যাখ্যা করা যায় ঋতুর ভয়াবহতা ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাব দিয়ে। সর্বাধিনায়ক জেনারেল অ্যানসন ছাড়াও ফরাসি পত্রে বলা হয়েছে, মারাত্মক তাপের শিকার হয়েছে প্রায় ৪,০০০ ইউরোপীয় সৈন্য; এমনকী ইংরেজি পত্রিকাতেও স্বীকার করা হচ্ছে যে, দিল্লির সম্মুখভাগের যুদ্ধে দুর্ভোগ সইতে হয়েছে শত্রু সৈন্যের গুলি থেকে ততটা নয়, যতটা রোদ্দুরের জন্য। যানবাহনাদির স্বল্পতায় আম্বালাস্থিত প্রধান ব্রিটিশ সৈন্যদের দিল্লি চড়াও হতে লাগে প্রায় সাতাশ দিন, অর্থাৎ দিনে পথ হেঁটেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা হারে। আম্বালায় ভারি কামান না থাকায় এবং সেই কারণে নিকট অস্ত্রাগার যা শতদ্রুর অপর পারে ফিলাউরে অবস্থিত। সেখান থেকে দখলি কামান বাহিনী নিয়ে আসতে আরও দেরি হয়।

আরো পড়ুন:  ভূমি থেকে কৃষিজীবী জনগণের উচ্ছেদ

এসব সত্ত্বেও দিল্লির পতন সংবাদ যে কোনো দিন আশা করা যায়; কিন্তু তারপর? ভারত সাম্রাজ্যের চিরাচরিত কেন্দ্রের ওপর বিদ্রোহীদের অবাধ দখলের এক মাসেই যদি বেঙ্গল আর্মির একেবারে ভেঙে পড়া, কলকাতা থেকে উত্তরে পাঞ্জাব ও পশ্চিমে রাজপুতানা পর্যন্ত বিদ্রোহ ও সৈন্যদল ত্যাগের ঘটনা ছড়ানো, ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ব্রিটিশ কর্তৃত্বকে টলিয়ে দেওয়ার দিক থেকে বোধ করি প্রবলতম উত্তেজিতকর কাজ হয়ে থাকে, তাহলে দিল্লির পতনে সিপাহীদের মধ্যে নৈরাশ্য ছড়ালেও তাতেই বিদ্রোহ প্রশমিত, তার প্রসার রুদ্ধ কিংবা ব্রিটিশ শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে, একথা ভাবা সবচেয়ে বড়ো ভুল। ২৮,০০০ রাজপুত, ২৩,০০০ ব্রাহ্মণ, ১৩,০০০ মুসলমান, ৫,০০০ নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বাকিটা ইউরোপীয় দিয়ে গড়া ৮০,০০০ সৈন্যের গোটা দেশীয় বেঙ্গল আর্মি থেকে বিদ্রোহ, দলত্যাগ ও বরখাস্তের দরুন ৩০,০০০ সৈন্যই অদৃশ্য হয়েছে, আর এ আর্মির বাকিটা থেকে কয়েকটা রেজিমেন্ট খোলাখুলিই ঘোষণা করেছে যে, তারা ব্রিটিশ কর্তৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত ও সমর্থন থাকবে শুধু দেশীয় সৈন্যদের যে কাজে লাগানো হচ্ছে শুধু সেই কাজটি বাদে। দেশীয় রেজিমেন্টের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করবে না, বরং সাহায্য করবে তাদের ‘ভাইয়া’দের। কলকাতা থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটা স্টেশনেই তার সত্যকার দৃষ্টান্ত মিলেছে। দেশীয় সিপাহীরা কিছুকাল নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে, কিন্তু সেই ধারণা হয় যে তাদের যথেষ্ট শক্তি আছে, অমনি বিদ্রোহ করে বসে। যে সব রেজিমেন্ট এখনো ঘোষণা করেনি এবং যে সব দেশীয় অধিবাসী এখনও বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলায়নি, তাদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখেননি The London Times-এর একজন ভারতস্থ সংবাদদাতা।

“সব শান্ত” তিনি বলেন, “এ কথা পড়লে বুঝবেন, এখনও পর্যন্ত দেশীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করেনি; অধিবাসীদের অসন্তুষ্ট অংশ এখনো খোলাখুলি বিদ্রোহ করেনি; তারা হয় অতি দুর্বল, অথবা ভাবছে যে তারা দুর্বল, নয়তো অপেক্ষা করছে আরও উপযুক্ত একটা মুহূর্তের জন্যে। ঘোড়সওয়ার বা পদাতিক কোনো দেশীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এর বিশ্বস্ততার পরিচয়ের কথা যখন পড়বেন তখন বুঝবেন যে, তার অর্থ তথা-প্রশংসিত রেজিমেন্টগুলির শুধু অর্ধেকটাই সত্যিই বিশ্বস্ত, বাকি অর্ধেকটা শুধু অভিনয় করছে যাতে বরং ইউরোপীয়দের অসতর্ক অবস্থায় পায়, নয়তো তাদের ওপর সন্দেহ না থাকার বিদ্রোহ ভাবাপন্ন সাথীদের যাতে আরও সহজে সাহায্য করতে পারে।”

পাঞ্জাবে প্রকাশ্য বিদ্রোহ নিরোধ করা গেছে শুধু দেশীয় সৈন্যবাহিনী ভেঙে দিয়ে। অযোধ্যায় ইংরেজরা কেবল রেসিডেন্সি লক্ষ্ণৌ দখলে রাখতে পেরেছে বলা যায়, তাছাড়া সর্বত্রই দেশীয় রেজিমেন্টগুলি বিদ্রোহ করেছে, গুলিগোলা নিয়ে পালিয়েছে, সমস্ত বাংলো পুড়িয়ে ছাই করেছে, এবং যোগ দিয়েছে হাতিয়ার তুলে ধরা অধিবাসীদের সঙ্গে। প্রসঙ্গত ইংরেজ আর্মির আসল অবস্থা সবচেয়ে ভালো প্রকাশ পাচ্ছে এই ঘটনায় যে, পাঞ্জাব ও রাজপুতানা উভয় ক্ষেত্রেই ভ্রাম্যমান কোর স্থাপন করা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। তার অর্থ, বিক্ষিপ্ত সৈন্যদলগুলির মধ্যে যোগাযোগ বহাল রাখতে ইংরেজরা তাদের সিপাহী সৈন্য বা দেশীয় অধিবাসীদের ওপর ভরসা করতে পারছে না। উপদ্বীপীয় যুদ্ধকালে ফরাসিদের মতো তারা শুধু স্বীয় সৈন্যাধিকৃত ভূমিটুকু এবং তদধীন পরিপার্শ্বটুকু শাসনে রাখছে। আর তাদের আর্মির বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলির মধ্যে যোগাযোগের জন্য তারা নির্ভর করছে ভ্রাম্যমান কোর-এর ওপর-এ। দলের কাজ এমনিতে অতি সঙ্গীন, তাতে যত বেশি জায়গা জুড়ে তা ছড়াবে, স্বভাবতই তত কমে যাবে তার প্রবলতা। ব্রিটিশ সৈন্যের বাস্তব অপ্রতুলতা আরও প্রমাণ হয় এই ঘটনায় যে, বিক্ষুব্ধ স্টেশনগুলি থেকে ধনসম্পদ সরাবার জন্য তারা বহনে সিপাহীদেরই লাগাতে বাধ্য হয়— সিপাহীরা বিনা ব্যতিক্রমে যাত্রাপথে বিদ্রোহ করে এবং ভার পাওয়া ধনসম্পদ নিয়ে ফেরার হয়। ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো সৈন্যরা যেহেতু সর্বোত্তম ক্ষেত্রেও নভেম্বরের আগে পৌঁছাবে না এবং মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে ইউরোপীয় সৈন্য টেনে আনা যেহেতু আরও বিপজ্জনক হবে— মাদ্রাজ সিপাহীদের ১০ নম্বর রেজিমেন্ট ইতোমধ্যেই বিক্ষোভের লক্ষণ দেখিয়েছে।

আরো পড়ুন:  আত্মনির্ভরতা ও কঠোর সংগ্রাম

তাই বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে নিয়মিত কর সংগ্রহের ধারণা ত্যাগ করতে হবে ও ভাঙনের প্রক্রিয়াকে চলতে দিতেই হবে। যদি ধরে নেই যে বর্মীরা এ উপলক্ষে ফায়দা ওঠাবে না, গোয়ালিয়রের মহারাজা ইংরেজদের সমর্থন করেই যাবে এবং সর্বোৎকৃষ্ট ভারতীয় সৈন্য যার হাতে আছে সেই নেপালের সেই অধিপতি শান্তই থাকবে, বিক্ষুব্ধ পেশোয়ার অশান্ত পার্বত্য উপজাতিদের সঙ্গে যোগ দেবে না এবং পারস্যের শাহ হেরাত ছেড়ে যাওয়ার মতো মূর্খতা দেখাবে না, এমন কী তাহলেও গোটা বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ফের জয় করতে হবে এবং গোটা ইঙ্গ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ফের গড়তে হবে। এই বৃহৎ ব্যাপারের খরচাটা সবই পড়বে ব্রিটিশ জনগণের ওপর। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় ঋণ মারফত প্রয়োজনীয় অর্থ তুলতে পারবে বলে লর্ড গ্রেনভিল লর্ড সভায় যে ধারণা দিয়েছেন তা কতো পাকা, তার বিচার হবে উত্তর পশ্চিম প্রদেশগুলির বিক্ষুব্ধ অবস্থায় বোম্বাইয়ের টাকার বাজারের প্রতিক্রিয়া থেকে। তৎক্ষণাৎ দেশীয় পুঁজিপতিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়, ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয়া হয়, সরকারি সিকিউরিটি বিক্রয়ের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং শুধু বোম্বাইয়ে নয়, তার চারপাশেও প্রচুর পরিমাণে মজুদের হিড়িক লাগে।

সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা বিশেষ সংখ্যা অক্টোবর বিপ্লববার্ষিকী ২০১৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!