রক্ত চিতা ও সাদা চিতা গুল্মের দশটি ভেষজ গুণাগুণ

রক্ত চিতা ও সাদা চিতা-র মধ্যে লাল ফুলের চিতা (Plumbago indica) রোগ প্রতিকারে বেশী উপযোগী। এর পার্থক্য প্রথমতঃ ফুলের রঙে, পাতার ও গাছের আকৃতিতে এবং মূল। তাছাড়া সাদা ফুলের চিত্রকের চলতি নাম সাদা চিতে। লাল চিতের বিকল্প হিসেবে সাদা চিতেও ব্যবহার হয়ে থাকে। লাল চিতের কাঁচা মূল বড় ব্যবহার করা হয় না, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বাহ্য ব্যবহারে (External use) কাঁচার ব্যবহার করা হয়।

প্রাচীন বৈদ্যগণ এই লালচিতের মূলকে চূর্ণের জলে একদিন ভিজিয়ে তার পরদিন তাকে ধুয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে আভ্যন্তরিক ঔষধাথে ব্যবহার করে থাকেন। তাঁদের মতে এইটাই হলো লাল চিতার মূলের শোধন পদ্ধতি। তবে সাদা চিতে (Plumbago zeylanica) মূলের শোধন করা হয় না কারণ তার দ্রব্যশক্তিও স্বল্প। এদের গাছ বা পাতার যে কোন গুণ নেই তা নয়, তবে তার বীর্যবত্তা অল্পই, সেইদিক থেকে সে হীনগণ।

রক্ত চিতা ও সাদা চিতা-র উপকারিতা:

. শ্লেষ্মপ্রধান শোথে: বয়সের শেষপ্রান্তেই এই শোথ হয়, যেটা আর কি বড়োকালের অসুখ এবং যাঁদের প্রোষ্টেট গ্লাণ্ড (Prostate gland) বড় হয়ে প্রস্রাব হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে থাকে, তাঁদেরও এই শোথ হ’তে দেখা যায়। এক্ষেত্রে শোধিত লাল চিতে মূল ৫০০ মিলিগ্রাম এক কাপ গরমজলে সিদ্ধ করে আধ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে ওই জলটা দু’বারে খেতে হবে। এর দ্বারা ওই শোথের উপশম হবে, আর অজীর্ণ অগ্নিমান্দ্য যদি থেকে থাকে সেও সেরে যাবে, যেহেতু এটি আমাশয়ের ও পাক্কাশয়ের অগ্নিবল বাড়িয়ে দেয়। আর অজীর্ণজনিত আমদোষে শোথ, হ’লে সেও কমে যাবে। তবে লালচিতের মূলের অভাবে সাদাচিতের মুল ব্যবহারও ক’রে থাকেন। এই সাদাচিতের মূলগুলি কাঠগর্ভ অর্থাৎ মূলের মধ্যটাই শক্ত কাঠের মত, তার এই শক্ত কাঠটাকে বাদ দিয়ে ওপরের ছালটাই নিয়ে থাকেন। তাও সেটাকে শুকিয়ে নিয়ে তারপর ঔষধার্থে ব্যবহার করা হয়।

২. উদর রোগে: উদর আর উদরীরোগ এক নয়; উদর রোগকে চলতি কথায় পেটের রোগ বলা হয়—সেটা আট প্রকারের। উদর আর উদরী রোগের কোন কোন লক্ষণ প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। ( এই রোগ হ’লে চলাফেরা করার অনিচ্ছা, খেলেই বা কি আর না খেলেই বা কি, পেট ফাঁপ, শরীরটা ভার বোধ, প্রায়ই পিপাসা, আর সর্বদাই মনে হয় ক্ষিধে লেগেছে, তার জন্য পেট জ্বালা করছে। এক কথায় বলতে গেলে রসবহ স্রোত আর উদকবাহী স্রোত বিকারগ্রস্ত হ’লেই উদর রোগ হয়। এদের মধ্যে বায়ু প্রধান হলে চিতা মূল চূর্ণ ২৫০ মিলিগ্রাম অল্প গরম জলসহ দু’বেলা কিছু, খাওয়ার পর খেতে হবে। এর দ্বারা দিন দুই-এর মধ্যেই উপকার পাওয়া যাবে।

আরো পড়ুন:  তরমুজ ও বীজের সাতটি ভেষজ গুণাগুণ ও উপকারিতা

৩. ক্রিমি রোগে: ক্রিমি আমাশয়জাত আর কয়েক প্রকার বিষ্ঠাজাত, এভিন্ন রক্তজাত ক্রিমিও আছে। এই চিতেমূল আমাশয়জাত ক্রিমিও শাসন করে, আবার বিঠাজাত ক্রিমির উপদ্রবের বিহিত করে। এভিন্ন বাহ্য ক্রিমি—এই যেমন চুলের গোড়ায়, গায়ে ছোট ছোট হয়, এক্ষেত্রে এর যে ক্ষমতা নেই তা নয়, তবে এটা প্রয়োগে প্রদাহ হতে পারে, যার জন্য ও জায়গায় লাল হয়ে উঠতেও পারে আবার ফোস্কাও যে হতে পারে না। তবে যেসব ক্রিমির উপদ্রব তিতা (তিক্ত) রস খাইয়েও কমানো যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রেও কাজ হয়ে থাকে, তবে মাত্রা সম্বন্ধে বিশেষ বিচার ক’রেই পরিমাণ ঠিক করতে হয়। সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রায় পূর্বাচার্যগণ এটা ব্যবহার করতেন না। তবে এক্ষেত্রে মোটামুটি একটা মাত্রা হলো, ১০০ মিলিগ্রাম আর বালকের মাত্রা ২৫ মিলিগ্রাম অল্প গরম জলসহ খাওয়ার বিধি। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে চিতের ব্যবহার খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে করতে হয়।

৪. গ্রহণী রোগে: এই সমস্যার জন্ম হয় পিত্তধরাকলা যেক্ষেত্রে। তবে মোটামুটি এক কথায় বলা যেতে পারে যে, আলোচ্য রোগটি বহু রোগের জন্ম দিতে পারে। কারণ এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীরের অগ্নিবল কমে যায়, যার ফলে অল্পরসের দ্বারা পিত্ত বিদগ্ধ হ’তে থাকে এবং তারই পরিণতিতে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এই ক্ষত গ্রহণী নাড়ীর বিভিন্ন স্থানে হ’তে পারে। যখন এটা আমাশয়ে হয় তখন তার নাম গ্যাসট্রিক আলসার (Gastric ulcer)। এর আর একটু অবস্থা এগিয়ে হ’লে সেটা হলো পেপটিক আলসার (Peptic ulcer)। আবার আরও একটু এগিয়ে হ’লে সেটা হলো আলসারেটিভ কোলাইটিস (Ulcerative colitis)। তারপর সমগ্র ক্ষুদ্রান্ত তো (Small intestine) আছেই। এক্ষেত্রে ১০০ মিলিগ্রাম চিতেমূল চূর্ণ ২৫/৩০ গ্রাম মিষ্টি দুই-এর সঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যহ একবার করে দুপুরের খাওয়ার পর খেতে হবে। এর দ্বারা অগ্নিবলটা বেড়ে যাবে। এটাতে ৪/৫ দিনেই ফল পাওয়া যাবে।

আরো পড়ুন:  টক চেরি শোভাবর্ধক ও ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্ম

৫. কৃশতায় (অগ্নিমান্দের): যাঁরা খেতে পারেন এবং খেয়েও যাচ্ছেন, অথচ বিশেষ কোন রোগ দেখা যাচ্ছে না, এসব ক্ষেত্রে বুঝতে হবে অগ্নিমান্দ্যের জন্য অল্পাহার কিম্বা শুকনো আমের জন্য কৃশতা। সেক্ষেত্রে চিতেমূল চূর্ণ ৭৫ মিলিগ্রাম মাত্রায় আধ বা এক কাপ দুধের সঙ্গে কিছুদিন দু’বেলা খেতে হবে এবং তার পূর্বে বা পরে অল্পকিছু খাওয়া দরকার। এক সপ্তাহের পর থেকে একবার করে খেলেও চলবে। এক মাসের পর থেকে এর উপকারিতা উপলব্ধি করা যাবে।

৬. অর্শ রোগ: এই রোগ যেকোন প্রকারেরই হোক না কেন, অর্থাৎ অন্তর্বলিই হোক আর বহির্বলিই হোক, সব ক্ষেত্রেই এটা খাওয়া চলবে। চিতেমূল চূর্ণ ১০০ মিলিগ্রাম মাখন ও মিশ্রির সঙ্গে অথবা ঘোলের সঙ্গে প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে। তবে খালিপেটে খাওয়া সমীচীন নয়। আর একটা কথা, যদি রক্তস্রাবী অর্শ হয়। (যাকে আমরা বলি রক্তা) সেক্ষেত্রে রক্ত পড়াও বন্ধ হবে এবং দপদপানিও কমে যাবে। অগ্নিমান্দ্যের দোষ থাকলে সেটাও সেরে যাবে।

৭. ক্ষতে: একে আমরা চলতি কথায় বলে থাকি ঘা। যে ঘা শুকোতে দেরী হচ্ছে, দুর্গন্ধ ছাড়ছে, তখন তার ওপর প্রলেপ দেওয়া ছাড়াও একটু করে খেতে হবে। ৭৫ মিলিগ্রাম চূর্ণ ঈষদুষ্ণ জলসহ প্রত্যহ একবার করে খাওয়ার বিধি।

৮. মেদহ্রাস: মেদস্বী হয়ে শরীরটা ভার হয়ে যাচ্ছে; সেক্ষেত্রে ৭৫ মিলিগ্রাম মূলচূর্ণ তার সঙ্গে শোধিত গুগগুলু, ৩০০ মিলিগ্রাম মিশিয়ে গরম জলসহ অথবা সিকি কাপ দুধসহ প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে। মাসখানেক খেলে মেদের হ্রাস হবে অথচ দুবলতা আসবে না, বরং কর্মশক্তি বেড়ে যাবে।

৯. শোথে: সে যেকোন প্রকারেরই হোক না কেন। তবে ব্রণ শোথে নয়, কাঁচা চিতেপাতা (তাই বলে বেড়াচিতে নয়) শাকের মত রান্না করে কয়েকটা দিন ভাত খাওয়ার সময় খেতে হবে। এর দ্বারা সহজ পদ্ধতিতেই শশাথের উপশম হবে।

আরো পড়ুন:  ছায়া উষ্ণমণ্ডলী অঞ্চলে জন্মানো ঔষধি বিরুৎ

১০. শ্লীপদ: যাকে আমরা চলতি কথায় গোদ বলে থাকি। এক্ষেত্রে চিতাপাতা বেটে লাগানো হতো, তবে তার আগে ওই ব্যাধিতস্থানে একটু, তেল বা ঘি মাখিয়ে নিয়ে পাতা বাটার লেপটা দিতে হয়, কিন্তু ২ ঘণ্টা বাদ ওটাকে ধুয়ে দিতে হবে। আর একটু সাবধান করে দিয়ে রাখি, হাত পা ভিন্ন অন্য কোন অঙ্গে ফাইলেরিয়া বা গোদ হলে সেখানে লাগালো চলবে না এবং উচিতই নয়। একদিন অন্তর এটা ব্যবহার করতে হয়; ২। ৪ দিন ব্যবহার করলে ওটার ধুমসো ভাবটা কমে যাবে, তবে সারবে না।

CHEMICAL COMPOSITION

Plumbago zeylanica The root-bark contains :— Plumbagin; free glucose and fructose (2.7%); enzymes, protease and invertase.

The leaves and stem contain volatile oil but little no plumbagin. Flowers contain:– azulein (5-methoxy quercetin 3-rhamnoside); 3-rhamnosides of delphinidin

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ১০১-১০৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!