গন্ধবেণা বা গন্ধ তৃণ এক প্রকারের তৃণ বা ঘাস, ৫/৭ ফুট লম্বা হয়, পাতা লম্বায় ৩/৪ ফুট। পাঞ্জাব, বোম্বে, বরোদা প্রভৃতি স্থানের বাগানে চাষ হয়। মহীশুরের কোথাও কোথাও জংলী ঘাস হিসেবেও পরিচিত। এই ঘাসে সাধারণতঃ ফুল হয় না, কচিৎ হতে দেখা যায়। ফুলের বোঁটা ছোট, পুষ্পদণ্ড সরু, একদিকে অবনত। ফুল উভয় লিঙ্গ, থোপা জোড়া। বর্ষাকালে ফুল হয়। তৈলের জন্য জাভা, সিংহল, বামা, মাদাগাস্কার, মরিশাস, দক্ষিণ আমেরিকার: অঞ্চল বিশেষে এর চাষ করা হয়। ভারতের কোন কোন অঞ্চলে তরকারি সুগন্ধি করার কাজে ব্যবহৃত হয়। এর তৈল West Indian lemon grass oil নামে পরিচিত।
সংস্কৃতে ভূস্কৃণ, অতিগন্ধা, সুগন্ধতৃণ ; বাংলায় গন্ধতৃণ, গন্ধবেণা ; হিন্দীতে গন্ধতৃণ, মহারাষ্ট্রে সুগন্ধি রোহিষু এবং ইংরেজীতে lemon grass নামে পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Cymbopogon citratus (Dc.) Stapf., পূর্বে এটির নাম ছিল Andropogon citratus Dc., Gramineae ফ্যামিলীভুক্ত। ভারতে এই গণের প্রায় ২৫টি প্রজাতি পাওয়া যায়। তাদের অনেকগুলিই সুগন্ধযুক্ত। কয়েকটির তৈল বানিজ্যিক দিক থেকে এবং ঔষধি গুণের জন্য খুবই মূল্যবান। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ : তৃণ, মূল ও তৈল।
গন্ধবেণা বা গন্ধ তৃণ-এর ঔষধ হিসাবে প্রয়োগ:
ঘাসের রস/কাথ: জ্বরঘ্ন, ঘর্মকারক, উদ্দীপক, মুখগহ্বর ও মাথার শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর প্রদাহের প্রতিষেধক, ম্যালেরিয়া রোগগ্রস্থ শোথরোগীর ক্ষেত্রে ফলপ্রদ ঔষধ। কৃমিনাশক, ক্ষুধাবর্ধক, বিরেচক, শিশুদের কাসিতে লাভদায়ক, আন্ত্রিক রোগে ব্যবহার্য, কামেচ্ছা নষ্ট করে। এই ঘাসসিদ্ধ জলে দুধ ও চিনি মিশিয়ে চায়ের মতো খাওয়া যায়। জাভাতে ঘাসের রস দিয়ে মসলাদার সুস্বাদু সরবত তৈরী হয়।
ইউনানি মতে–এর রসে ৪০ দিন গন্ধককে ভিজিয়ে রেখে রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঐ গন্ধক ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় পানের সঙ্গে খেলে ক্ষুধা বৃদ্ধি হয়।
তৈল :- ঘর্মকর, উদ্দীপক, পেটফাঁপা ও আক্ষেপ নিবারক। আমাশয়শূলের মূল্যবান ঔষধ। কলেরায় বমননিবারক, অবসাদ নষ্ট করে ও বলকর। পুরাতন বাত, স্নায়ুশূল, মচকানো ব্যথা, আঘাতজনিত ব্যথায় খাওয়ালে ও মালিশ করলে ভাল কাজ হয়।
১. জ্বরে: যেকোন জ্বরে নয়, পিত্তজ্বরে এটি ভাল কাজ করে। জ্বর, সেইসঙ্গে শরীরে দাহ, পায়খানা হচ্ছে না, ক্ষুধা কম, পেটে অল্প-বিস্তর ব্যথাও আছে; অথচ এটি ম্যালেরিয়া বা টায়ফয়েড জ্বর নয়। সেক্ষেত্রে মূল সমেত শুকনো ঘাস ২৫ গ্রাম নিয়ে ৫/৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে, ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেটিকে ২ কাপ মাত্রায় সারাদিনে ৪ বারে খেতে হবে। এতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়বে এবং অন্যান্য উপসর্গগুলিও চলে যাবে। ২/৩ দিন এভাবে খাওয়া দরকার।
২. অগ্নিমান্দ্যে: ক্ষুধা ভাল হচ্ছে না, দাস্তও পরিষ্কার হয় না, মাঝে মাঝে পেট ফাঁপে, এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে ক্বাথ তৈরী করে সপ্তাহখানিক খেলে ক্ষুধা বাড়তে আরম্ভ করবে। তারপর আরও কিছুদিন ঐ মাত্রায় দিনে ২ বার করে খেতে হবে। অর্থাৎ ১০/১২ গ্রাম মূল সমেত শুকনা ঘাস ৩/৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, হেঁকে, সেটিকে দু’বারে খাওয়া প্রয়োজন।
৩. ক্রিমিতে: ছোট ছোট ক্রিমি অথবা কেঁচো ক্রিমি, যেটিরই উপদ্রব হোক না কেন, তখন মূল সমেত শুকনা ঘাসের (১০/১২গ্রাম) ক্বাথ উপরিউক্ত পদ্ধতিতে তৈরী করে সকালে ও বিকালে দু’বারে কয়েকদিন খেলে এর উপদ্রব থেকে রেহাই পাবেন। তবে ক্রিমির জন্মসুত্র আর উপদ্রব এমনি যে কিছুদিন পরে আবার হবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।
৪. কামজ উন্মাদে: এটি কি ছেলে আর কি মেয়ে, উভয়ের যৌবনেরই রোগ। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এর শিকার হন বেশি। ছেলেদের হলে তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তখন যৌনাচারে কোন বাছ-বিচার, সময়-অসময়, ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে না; আর মেয়েদের হলে প্রথমটা চুপচাপ, যতক্ষণ সম্ভব নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, তারপর সামলাতে না পারলে ছেলেদের মত কেউ কেউ নির্লজ্জ হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু যৌনাচারে কোন বাছ-বিচার করা সম্ভব হয় না, আর যারা সে পথে না যায়, তারা মানসিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। যে, যে পথেই পা বাড়াক না কেন, রোগের শান্তি হয় না, অর্থাৎ কোন কিছুতেই যৌনসুখের আশ আর মেটে না। এ ক্ষেত্রে মূল সমেত শুষ্ক ঘাস ২৫ গ্রাম ৫/৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, হেঁকে, সেটিকে দিনে ৩/৪ বারে খাওয়াতে হবে। তবে ঐসঙ্গে দুধ ও চিনি মিশিয়ে সরবতের মত করে খাওয়ালে আরও ভাল হয়।
এসময় উত্তেজক খাবার এবং যৌন-সম্বন্ধীয় আলোচনা ও পড়াশুনা থেকে রোগীকে দূরে রাখা প্রয়োজন। এ অবস্থায় অনেকে বিয়ে দেবার পক্ষপাতী এবং কেউ কেউ তা দেনও, কিন্তু বিয়ে না দেওয়াটাই উচিত। বিয়ে দিলে উভয়েরই জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠার এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষময় ফল হবার সম্ভাবনা থাকে। রোগী সুস্থ হলে কিছুদিন বাদে বিয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। তবে উপরিউক্ত যোগটি নিয়মিতভাবে ২/৩ মাস খাওয়াতে হবে।
৫. স্নায়ুশূলে: এর তৈল মালিশ করলে উপকার হয়। এই তৈলটি Lemon grass oil নামে পরিচিত।
৬. মচকানো ও আঘাতজনিত ব্যথায়: মচকে গিয়ে বা আঘাত লেগে ব্যথা হলে, ফুলে গেলে, অথচ হাড় ভেঙ্গে যায়নি এবং রক্তপাতও ঘটেনি, সেক্ষেত্রে এই তৈল ১০ ফোঁটা করে দিনে ২/৩ বার খেতে হবে এবং এটিই ব্যথিতস্থানে হালকাভাবে লাগিয়ে রাখতে হবে। ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ২৬৫-২৬৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
এই গাছের ভেষজ গুণ জেনে উপকৃত হলাম। ধন্যবাদ।