গণতন্ত্র ও নীতিবিদ্যার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে

গণতন্ত্রে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দের বোধকে সমসাময়িক কালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নবায়ন করে নিতে হয়। গণতন্ত্রে নীতিবিদ্যাকে সময় পরিবর্তনের সাথে যুগোপযোগী করে নিতে হয়। বাংলা ভাষায় ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি শব্দ থাকলেও এসব কথা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখিত আলোচনা নেই। আর নীতিবিদ্যা বা নীতিশাস্ত্র [ইংরেজি:ethics] বলে যে একটি পাঠ্য বিষয় আছে সেই বিষয়টিকে এদেশে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এদেশে নীতি-নৈতিকতা, নীতিশাস্ত্র, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ের সাথে ধর্মপালন করাকে গুলিয়ে ফেলা হয়। এদেশের মানুষ নীতি ও মূল্যবোধ বলতে ধর্মগ্রন্থ অনুসারে নিয়মিত ধর্মপালন করাকেই বোঝে।

নীতিশাস্ত্র বা নীতিবিদ্যা মানব নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত প্রশ্ন যথা—ভাল-মন্দ, সঠিক-বেঠিক, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের ধারনাসমূহ ও সেসব সম্পর্কিত প্রশ্নসমূহের সমাধান চায়। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের আচরণের নৈতিকতার মূল্যায়ন করা নীতিশাস্ত্রের অনেক কাজের একটি।  

মানুষ যেহেতু নৈতিকতার আবছায়া নিয়ে থাকে না; মানুষ চরিত্র ও কর্ম দিয়ে তার নৈতিকতাকে মূর্ত করে তোলে। তার কর্ম শুধু তার নিজের জন্য কর্ম নয়; তার কর্ম অজস্র অগণন মানুষের জন্য যাদের জীবন ব্যক্তিগত মালিকানা ও পুঁজিবাদী সমাজ উদ্ভবের পর টাকা ও মুনাফার চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে মরতে বসেছে। তাই একজন নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের কর্ম মানেই সেই মানুষগুলোর জন্য কর্ম যারা এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে মানুষ হতে পারেনি অভাবের যন্ত্রণায়।

নৈতিকতা কোথায় থাকে এবং কোথা থেকে আসে? এটি মানবের সাথেই থাকে এবং তার ভিত্তি থেকেই তৈরি হয় এবং সমাজ বদলের সাথে সাথে তার রূপ বদলে যায়। মানবসমাজ-বহির্ভূত, শ্রেণী-বহির্ভূত কোনো নৈতিকতা থাকতে পারে না।

তাহলে প্রশ্ন উঠে নৈতিকতা কী? কেমব্রিজ দর্শনের অভিধানে বর্ণনা করা হয়েছে যে নীতিশাস্ত্রকে ‘সাধারণভাবে নৈতিকতার সাথে (Morality) আন্তঃপরিবর্তিত করে ব্যবহার করা হয়….. এবং মাঝেমাঝে এটিকে আরো সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয় একটি বিশেষ ঐতিহ্য, দল বা ব্যক্তির নৈতিক বিধি বোঝাতে।’[১]    

কোন মানুষটিকে আমরা বলবো এক পুর্ণাঙ্গ নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ? যে মানুষটি এই গলিত সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে এমন একটি সমাজ নির্মাণ করার জন্য জীবনব্যাপী সাধনা করেন যেখানে অভাব ও মানবাত্মার পঙ্গুত্ব থাকবে না। মানুষ প্রাণী হিসেবে তার যুথবদ্ধতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও যৌথ গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে না।

আরো পড়ুন:  নীতিশাস্ত্র দর্শনের জনপ্রিয়, প্রযোজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা

আমরা জানি, যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছুই বদলে যায়। নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতির আবির্ভাবের ফলে মানুষের চিন্তাও বদলে যায়। ফলে পুরনো নীতি-নৈতিকতা দিয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা চলে না। নতুন সমাজে নতুন নীতি প্রণয়ন করার দরকার পড়ে। রাষ্ট্রীয় আইনগুলো থেকে যায় অতীতের, কিন্তু সমাজ বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া সমাজের জন্য দরকার পড়ে প্রগতিশীল আইন। কারণ অতীতের আইনগুলো রাষ্ট্রসম্মত হলেও তা ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিযুক্ত  বা মানবিক না হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। সমাজ বদলে গেলে ন্যায়নীতি, নৈতিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন চিন্তা ও নতুন মূল্যবোধ দানা বাঁধতে থাকে; যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় আইন ও নায্যতা সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন ও ধারনার জন্ম হয়। এই নতুন প্রশ্নটিই তোলে সমাজপ্রগতির পতাকার ধারক সমাজের নতুন শ্রেণিটি।

যে মানুষটি নতুন সমাজের জন্য নতুন নৈতিকতাকে মেনে না নিয়ে পুরোনো নৈতিকতা ও পুরোনো নিয়ম জোরপূর্বক অন্যের উপর চাপাতে চান, তাকে আমরা অনৈতিক না বললেও পশ্চাদপদ নৈতিক ধারণাসম্পন্ন বলতে পারি। আমরা মানি যুগের হাওয়া বদলে দেয় অনেক কিছুকে। নতুন কালের নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আবির্ভাবের ফলে মানুষের চিন্তা চেতনা ও চিন্তাধারা পাল্টে যায়। আর তখনই পুরোনো নৈতিকতা দিয়ে আর চলে না।

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নৈতিকতা নির্মিত হয়েছিল বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সাংবিধানিক রূপ দিতে গিয়ে। সেই সংবিধানে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, চলাফেরা ও উপার্জনের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার পাবার স্বাধীনতার সাথে সাম্য, মৈত্রী, নাগরিকের সমান সুযোগ ও অধিকার এবং ধর্মের প্রতি আস্থা-অনাস্থার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এর বিপরীতে উনিশ শতকে মার্কস-এঙ্গেলস ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকদের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছিল সাম্যবাদী নৈতিকতা।

আগের সমাজগুলোর ভিত্তিতে যে নৈতিকতা কাজ করতো তা হচ্ছে শোষণ করার নৈতিকতা। গত কয়েক হাজার বছর ধরে বলা হয়েছে যে, শোষণ করা অন্যায় নয়, গরিবের সম্পদ দখল করা অন্যায় নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ এসেই নৈতিকতা বদলেছে। এই বিষয়ে লেনিন লিখেছেন যে,

“সাবেকী সমাজের ভিত্তি ছিলো এই নীতি; লুঠ করো নয় লুণ্ঠিত হও, অন্যের জন্য খাটো, নয় অন্যকে নিজের জন্য খাটাও, হও দাসমালিক, নইলে হও দাস। স্বভাবতই এরকম সমাজে বেড়ে ওঠা লোকেরা, বলা যেতে পারে, মায়ের দুধের সঙ্গে সঙ্গেই পায় এই মনোবৃত্তি, এই অভ্যাস, এই ধারণা: তুমি হয় দাসমালিক নয় দাস, নয় এক ক্ষুদে মালিক, একজন ক্ষুদে কর্মচারী, একজন ক্ষুদে রাজপুরুষ বা একজন বুদ্ধিজীবী — সংক্ষেপে এমন লোক যে কেবল নিজের কথাই ভাবে, কারও জন্য যার এতটুকু মাথাব্যথা নেই”।[২]

সামন্তীয় ও বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত নীতি দ্বারা বর্তমান বাংলাদেশের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড ও নিয়মবিধি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেশ পুঁজিবাদী হলেও দেশের সৃষ্টিশীল শ্রমিক-কৃষক অনেক এগিয়ে গেছে। আর পরগাছা পুঁজিপতি, আমলা, বুর্জোয়া রাজনীতিবিদেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণকে শোষণ করছে। এ অবস্থায় দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী পুলিশ ও আমলাদের দিয়ে জনগণকে পীড়ন করছে।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট নৈতিকতা সাম্যবাদী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট জনগণের নৈতিকতার অনুশীলন

গণতান্ত্রিক মানুষ হিসেবে গণতান্ত্রিকদের প্রথম কাজ হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন দূর করার জন্য সামন্তীয় ও বুর্জোয়া সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত নিয়মকানুনকে বর্জন করা এবং নতুন নীতি-নৈতিকতা নির্মাণ করা। যারা গণতন্ত্র চায় তাদের জানা প্রয়োজন, দাস ও সামন্তীয় সংস্কৃতিতে কিছু কাজকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সেসব পুরনো দাস ও সামন্তীয় যুগের ধর্মীয় বিধানের নৈতিক উপদেশ দিয়ে বর্তমানকালের জটিল অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, বিবর্তনবিদ্যা, মানবিক আইন, জাতিয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং বর্তমানকালের উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বর্তমান সমস্যাসমূহের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানের জটিল পৃথিবীর নানা জটিল বিষয়কে যখন রক্ষণশীল গোষ্ঠী ব্যাখ্যা করতে পারে না তখন তারা সকল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপক্ষে দাঁড়ায়। রক্ষণশীল ধর্মীয় উপদেশ দিয়ে একুশ শতকের জীবন চলতে পারে না, চলছেও না। ধর্মের সংগে নৈতিকতার এক বিরোধ বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এ-সম্পর্কে আইনস্টাইনের একটি উক্তি কেউ কেউ স্মরণ করতে পারেন; তিনি বলেছেন,

“মানুষের নৈতিকতার জন্য তো ধর্মের কোনো দরকারই নেই, দরকার মানবিকতা, সহমর্মিতা, শিক্ষা আর সামাজিকতার। মানুষ যদি পরকালের শাস্তির কথা ভেবে নৈতিক হয়, সেই নৈতিকতার মধ্যে মহত্ত্ব কোথায় থাকে?”[৩]

বারট্রান্ড রাসেলও একই  ধরনের মত প্রকাশ করেছেন যদিও এই বুর্জোয়া দার্শনিক ধর্মকে আক্রমণ করেছেন এবং নৈতিকতা ও ধর্মের বিরোধটিকে সমর্থন করেছেন।[৪] তিনি এইটি বুঝতে পারেননি যে, প্রতিটি নতুন যুগের মানুষকে নতুন নৈতিকতা তৈরি করে নিতে হয়। বাংলাদেশেও এখন নতুন নৈতিকতা ও নতুন নীতিশাস্ত্র সৃজন দরকার। নতুন নৈতিকতার রূপ কী হবে তা নির্ধারণ করা দরকার।[৫]

তথ্যসূত্র ও টীকাঃ

১. John Deigh in Robert Audi (ed), The Cambridge Dictionary of Philosophy, 1995.
২. ভি আই লেনিন, ২ অক্টোবর, ১৯২০, যুব লীগের কর্তব্যসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বক্তৃতা ও প্রবন্ধ সংকলন, প্রগতি প্রকাশন মস্কো ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৫২৭-৫২৮
৩. Albert Einstein, Religion and Science, New York Times Magazine, 9 November 1930
৪. বারট্রান্ড রাসেলের উক্তিটি হচ্ছে: প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, ধর্মকে আক্রমণ করা ঠিক নয়, কারণ ধর্ম মানুষকে নীতিবান করে। আমি তেমনটা শুনেছি, দেখিনি।
৫. নিবন্ধটি আমার সম্পাদিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থের বাঙালির অগণতান্ত্রিকতা প্রবন্ধের অংশবিশেষ। এখানে কিছুটা সম্পাদনা ও সংযোজন করা হয়েছে। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বইটি বাংলাদেশে রকমারি ডট কম থেকে কিনুন এই লিংকে গিয়ে

আরো পড়ুন:  চুক্তি কাকে বলে

রচনাকালঃ মে ১৭ ২০১৩

Leave a Comment

error: Content is protected !!