সারা রুশ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি, মস্কো সোভিয়েত, কারখানা কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির যুক্ত অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত

Report at a Joint Session off the All-Russia Central Executive Committee, The Moscow Soviet, Factory Committees and Trade Unions —V. I. Lenin [১]

২২ অক্টোবর, ১৯১৮

সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রলেতারীয় জনগণ ও কৃষকদের বিপ্লবী আন্দোলন ইদানিং বিভিন্ন দেশে বিপুল সাফল্য লাভ করেছে, বিশেষ করে বলকান, অস্ট্রিয়া আর জার্মানিতে। এইসব সাফল্যের কারণেই আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের বিশেষভাবে আক্রোশে অন্ধ করে তুলেছে, এখন যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসী বুর্জোয়ারা, এবং বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য তাড়াহুড়ো করে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা তারা জোরদার করে তুলেছে, সর্বাগ্রে রাশিয়ার সোভিয়েত ক্ষমতাকে ধ্বংস করার জন্য, যে রাশিয়া এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিপ্লবের প্রধান উর্বর ভূমি।  

জার্মান বুর্জোয়া ও জার্মান সরকার যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে এবং শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বিপ্লবী আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরিত্রাণের আশায় ছোটাছুটি করছে। জার্মানির শাসক মহলের একটা ধারা আশা করছে যে এখনও গড়িমসি করে শীত পর্যন্ত সময় পেয়ে যাবে এবং ততদিনে দেশের সামরিক প্রতিরক্ষার প্রস্তুতিতে নতুন প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে নিতে পারবে। অন্য ধারাটি উদভ্রান্ত হয়ে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত ও বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে একটা আপোস রফায় আসতে চাচ্ছে। এই ধারাটি যতই ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের চূড়ান্ত একগুঁয়েমির সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে, ততই তারা ওদের বলশেভিকদের দিক থেকে আসা বিপদের ভয় দেখাচ্ছে, বলশেভিকদের বিরুদ্ধে, প্রলেতারীয় বিপ্লবের বিরুদ্ধে তাদের উপকার করে দিয়ে ওদেরকে হাত করতে চাচ্ছে।

জার্মানির অধীনস্থ অথবা অধিকৃত দেশগুলির বুর্জোয়ারা জোটের[২] সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার জন্য আরও উঠে-পড়ে লেগেছে, বিশেষ করে সেইসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ ফিনল্যান্ড, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে তারা বুঝেছে যে বিদেশি বেওনেটের সহায়তা ছাড়া এইসব দেশে শোষিত জনগণের ওপর তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা একেবারেই অসম্ভব।

পরিস্থিতির এইসব শর্তের কারণে সোভিয়েত সরকার একটা বিশেষ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে নিজেই পতিত হয়েছে: একদিকে এখনকার মতো আন্তর্জাতিক বিপ্লবের এত কাছাকাছি আমরা কখনও আসিনি; অন্যদিকে এখনকার মতো এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও আমরা কখনও পড়িনি। পরস্পরকে গ্রাস করছে এবং দুর্বল করছে সাম্রাজ্যবাদীদের এমন প্রায় সমান দুটি লুটেরা গ্রুপ আর উপস্থিত নেই। এখানে বিজয়ী একটি গ্রুপই রয়ে গেছে, ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের গ্রুপটা, এরা পুঁজিপতিদের মধ্যে সমগ্র বিশ্বটাকে ভাগ করে নেবার উদ্যোগ করছে। এরা যে করেই হোক রাশিয়ায় সোভিয়েত সরকার উচ্ছেদ করে তদস্থলে বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এরা এখন দক্ষিণ দিক থেকে রাশিয়াকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, দৃষ্টান্তস্বরূপ দার্দানেলিস আর কৃষ্ণসাগর দিয়ে অথবা বুলগেরিয়া আর রুমানিয়া হয়ে। এছাড়াও, অন্তত ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের একাংশ স্পষ্টতই আশা করছে যে ইঙ্গ-ফরাসী সৈন্যবাহিনী ইউক্রেনকে যতই অধিকার করতে থাকবে কেবল সেই মাত্রায় প্রত্যক্ষ অথবা অকথিত বোঝাপড়া অনুসারে জার্মান সরকার ইউক্রেন থেকে তার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেবে, যাতে করে ইউক্রেনের শ্রমিক ও কৃষকদের বিপ্লবের যে বিজয় এবং শ্রমিক ও কৃষক সরকার প্রতিষ্ঠা অন্যথায় অনিবার্য হয়ে ওঠেছে তা আর ঘটতে না পারে।

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমুহ ও সাম্রাজ্যবাদ একসাথে অসীমকাল টিকবে না

ক্রাসনভী ও শ্বেতরক্ষী প্রতিবিপ্লবীদের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়ারা, এর মধ্যে সবার আগে রয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসী বুর্জোয়ারা, এরা অনেক বেশি শক্তিমত্তা নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাস্তবতা এই যে সবখানে এই ধারণাটা অনুধাবন করা হয়েছে এবং ব্যাপক শ্রমিক ও কৃষক সাধারণের অতি গভীরে ঢুকেছে এমন নয়। তাই ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে জনগণের মধ্যে এই চেতনা আমাদের নিয়ে যেতে হবে। দক্ষিণ ফ্রন্টের শক্তিবৃদ্ধির জন্য এখনকার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী একটা লালফৌজ বাহিনী গঠন করতে হবে এবং তাকে সশস্ত্রকরণের জন্য অনেক বেশি একনিষ্ঠ মনোযোগ দিতে হবে। প্রত্যেক শ্রমিক সংগঠনকে, প্রত্যেক গরিব কৃষক ইউনিয়নকে, প্রত্যেক সোভিয়েত প্রতিষ্ঠানকে সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির বিষয়টাকে বারবার আলোচনার প্রধান প্রশ্ন হিসেবে সামনে নিয়ে আসতে হবে, আমরা কি যথাসাধ্য করেছি, আর কোনো ব্যবস্থা আমরা কি নিতে পারি বা নেওয়া উচিত কি, এই বিষয়গুলি বারবার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

আমাদের শ্রমিক ও কৃষক জনসাধারণের মনোভাবে একটা স্পষ্ট বাঁক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট চরম অবসন্নতা জনগণ এখন কাটিয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে তা করা হয়েছে। নতুন কমিউনিস্ট শৃঙ্খলার প্রসার ঘটছে, সচেতন শৃঙ্খলা, শ্রমজীবী মানুষের শৃঙ্খলা। এসব ঘটনা থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে এমনটা প্রত্যাশা করার পুরোপুরি ভিত্তি পাচ্ছি যে আমরা আমাদের সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমি এবং আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় বিপ্লবের বিজয় রক্ষা করতে পারবো এবং রক্ষা করবোই।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. মস্কোয় ১৯১৮-এর ২২ অক্টোবর এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। লেনিন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর এই অধিবেশনে তার রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। আর এই রিপোর্টের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত এই অধিবেশনে গৃহীত হয়, এটিই সামান্য পরিবর্তনসহ ষষ্ঠ সোভিয়েত কংগ্রেসে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট হিসেবে অনুমোদিত হয়।

২. জোট—এটি ছিল ত্রয়ীর মৈত্রীজোট — ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জারশাসিত সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার মৈত্রীজোট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই জোটে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি আরও কয়েকটি রাষ্ট্র। নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই জোটভুক্ত দেশগুলি সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছিল।

আরো পড়ুন:  অক্ষশক্তি একটি সামরিক জোট যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল

৩. ভ. ই. লেনিন, কালেক্টেড ওয়ার্কস, ২৮তম খণ্ড, প্রগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো ১৯৭২, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃঃ ১২৭-১২৯, ১৯১৮-এর ২৩ অক্টোবর, ইজভেস্তিয়া’র ২৩১ নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রোদ্দুরেতে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি শেখর রহিম কর্তৃক অনূদিত লেনিনের নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ-৪ শ্রাবণ, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২০১৬, পৃষ্ঠা ৩৬০-৩৬২ থেকে নেয়া।

Leave a Comment

error: Content is protected !!