বাংলার ইতিহাস জড়িত দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সাথে

বাংলার ইতিহাস দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির ইতিহাসের সাথে জড়িত। এই বাংলা অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আধুনিক কালের বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের পূর্ব অংশে অবস্থিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশসমূহ, আর যুক্ত করেছে বঙ্গোপসাগরের চুড়ায় অবস্থিত এবং উর্বর গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলের জনপদসমূহ। বাংলায় সভ্যতার অগ্রগতি গত চার সহস্রাব্দের।

প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রাচীন জাতি পুরা আর্যসভ্যতার বহুপূর্বেই এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলাে। পুণ্ড্রদের নামানুসারেই এই দেশের নাম হয় পুণ্ড্রদেশ। কোনাে কোনাে শাস্ত্রীয় যুগে পুণ্ড্রদের অসুর বলে চিহ্নিত করা হয়। কালের পরিক্রমায় পুরা আর্য-সংস্কৃতি গ্রহণ করতে থাকে। মৌর্য শাসন কালে পুণ্ড্রদেশ ঐশ্বর্যপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। মৌর্য শাসনের পূর্বেই দূর্গ নগরী পুণ্ড্রনগর প্রতিষ্ঠিত হলেও মৌর্য যুগেই পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হয়। প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য যে উত্তরীয় দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলাে তার যথেষ্ট প্রমাণ ঐতিহাসিকরা খুঁজে পান। করতােয়া নদীর বিশাল জলপ্রবাহ পুণ্ড্রনগরকে সুজলাসুফলা করে তুলেছিলাে।

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: প্রাচীন বাংলার ইতিহাস খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত বিস্তৃত

সাধারণত ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী আগের সময় থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীকেই প্রাচীনকাল বা যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে এই সময়ের মধ্যে তারতম্যও লক্ষ করা যায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাবের কার্যকারিতা নিয়েই এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দুই হাজার বছর সময়কে প্রাচীন যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে।

অস্ট্রিকরাই এখানে কৃষি ও পশুপালনের সূচনা করেছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি জনগােষ্ঠী অস্ট্রিকদের বংশধর। দ্রাবিড়গণ গঙ্গা তীরবর্তী বাংলা অব্দের পরে এই সংখ্যা উল্লেখযােগ্য সংখ্যক হারে বাড়তে থাকে।

প্রাচীন বাংলায় কোম বা কৌম বা গোত্রই (ইংরেজি: tribe) হচ্ছে সুসংগঠিত প্রথম দলবদ্ধ সমাজ। বিভিন্ন নরগােষ্ঠী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোম জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কোমগুলাে একের সঙ্গে অন্যের যােগাযােগ ও আদানপ্রদান তেমন ছিল না।

অবশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক আদান-প্রদান রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ছােট-বড় কোমের সমবায়ে বৃহত্তর কোমের (বঙ্গ, সুম্ম, পুণ্ড্র, কলিঙ্গ, রাঢ় ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটেছে। এর ফলে বাংলার সমাজে যেসব জনপদ’ পরিচয়ে প্রাচীন বিশেষ ধরনের ছােট ছােট আদি রাষ্ট্রে উদ্ভব ঘটেছিল তা বঙ্গীয় প্রাচীন সমাজকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করেছে।

ধ্রুপদী বাংলার ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: ধ্রুপদী বাংলার ইতিহাস প্রথম স্বাধীন বঙ্গের গৌরবোজ্জ্বল যুগ

ধ্রুপদী বাংলা (ইংরেজি: Classical Bengal) হচ্ছে বঙ্গে ৬০৬ অব্দ থেকে সেন আমলের অর্থাৎ ১০৭০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলার প্রাচীন ধ্রুপদী স্বাধীন গৌরবোজ্জ্বল সময়। বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎস হিসেবে এই সময়ের রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালকে সনাক্ত করা হয়েছে। ১০৭০ সাল থেকে বাংলা দাক্ষিণাত্যের সেন সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ১০৯৭ সালে বাংলা পরাধীন হয়ে যায় বিদেশী বিভাষী সেন রাজাদের দ্বারা। এবং এর ফলে বাংলায় মধ্যযুগীয় পরাধীন আমল শুরু হয়।

৬ষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য অন্তঃর্বিবিদ্রোহ ও হুণজাতির বার বার আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই অস্থিতিশীল পরিবেশে বাংলাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। এর একটি হচ্ছে স্বাধীন ‘বঙ্গ রাষ্ট্র’, অপরটি ‘গৌড় রাজ্য’ এবং এই ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসে ধ্রুপদী বাংলা গড়ে ওঠে।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্রের রাজারা তামার পাতে খােদাই করা রাজ নির্দেশ জারি করতেন। এগুলােকে তাম্রশাসন বলা হতাে। এ রকম ৭টি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। স্বাধীন বঙ্গরাজ্যে চন্দ্রগুপ্ত, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামের তিনজন রাজার নাম জানা যায়। তারা ৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তু মােট ৭৫ বছর রাজত্ব করেন। বঙ্গের রাজাগণ ‘মহাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করতেন। এতে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। স্বাধীন বঙ্গের যথেষ্ট যশ, খ্যাতি, প্রভাব ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে দাক্ষিণাত্যের চাণক্য রাজবংশের রাজা কীর্তি বর্মণ দ্বারা বাংলা আক্রান্ত হয়।[১]

আবার কেউ কেউ মনে করেন সপ্তম শতকের গােড়ার দিকে গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের নেতৃত্বে বাংলার পুন্ড্র বা পন্ড্রবর্ধন, গৌড় এবং বঙ্গকে একত্রিত করে একটি বিশাল গৌড় রাজ্য স্থাপিত হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কিছুদিন তার পুত্র রাজপুত্র মানব স্বাধীন রাজ্য শাসন করেছেন। রাজা শশাঙ্কই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য কৃষ্টি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন মূলত শিবভক্ত। তাঁর সময়কালে শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্ম প্রসার ঘটেছিলাে। শশাঙ্কের পুত্র মানবের রাজত্বকালে বৃহৎ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। মানবের পরে গৌড় বা বঙ্গদেশে কে বা কারা শাসন করেছিলাে তা ইতিহাসবিদরা বের করতে পারেননি। মানবের পরে প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই ১০০ বছরের ইতিহাসকে ঐতিহাসিকরা অন্ধকার যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এই অন্ধকারময় যুগে বঙ্গদেশ বহিঃশত্রুর আক্রমণে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। যার ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়ে পড়ে। দেশের ভেতর অরাজকতা তৈরি হয় অর্থাৎ যে যেভাবে পারে সেভাবেই রাজ্য দখল করে লুণ্ঠন করতে থাকে। উত্তরবঙ্গসহ সারা বঙ্গে মাৎস্যন্যায় নামক এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রায় ১০০ বছরের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটান রাজা গােপাল। তিনি ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন। তিনি রাজ্য লাভের পর একটা শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন।

পাল আমলে বাংলা

উত্তবঙ্গের কোন অঞ্চলে গােপাল তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা এখনাে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। গােপালের উত্তর পুরুষদের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, তাঁর রাজ্য দক্ষিণে সমুদ্রতীর পর্যন্ত প্রসারিত ছিলাে। তবে উত্তর দিকে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলাে তা কেউ বলতে পারেন না। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রামচরিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘বরেন্দ্রভূমি পাল রাজাদের আদিপুরুষদের ভূখণ্ড, সে কারণে বােঝা যায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার কোনাে একটা অংশ রাজা গােপালের অধীনস্ত ছিলাে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রাজা গােপাল রাজধানী স্থাপন করেছিলেন দেবকোটে। যা বর্তমানে বানগড় নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে পালরাজাদের একাধিক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুণ্ড্রবর্ধন ও গৌড়ে।

রাজা গােপালের মৃত্যুর পর তাঁর সতেরাে জন বংশধর বাংলাদেশে চারশত বছর রাজত্ব করেন। সুদীর্ঘ পাল শাসন এই বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবময় যুগ। যাকে স্বর্ণযুগ বললেও ভুল হবে না। ধর্মপাল ও দেবপাল বাহুবলে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা বিগ্রহ পাল ও নারায়ণ পালের ৫৪ বছরের রাজত্ব রক্ষা করতে পারেনি। নারায়ণ পালের রাজত্বকালেই পাল সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ে। এমনকি বিহার ও বাংলাদেশের কোনাে কোনাে অংশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধমে বাইরের শত্রুরা দখল করে নেয়। এই সময়ের ভেতরে রাষ্ট্রকূট রাজ অমােঘবর্ষ, রাষ্ট্রকূট রাজ দ্বিতীয়, প্রতীহার রাজকৃষ্ণ, ইন্দ্র এইসব বহিঃশত্রুর আক্রমণে পাল সাম্রাজ্য নিদারুণ ধ্বংসের মুখে পড়ে। এরপর প্রায় একশ বছর বিভিন্ন পাল রাজা বাংলা শাসন করেন।

আরো পড়ুন:  মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে কর্ণাটকের সেন ও দিল্লির সুলতানী শাসনের অধীনতা

পাল রাজাদের চার’শ বছরের আধিপত্য বঙ্গদেশের ইতিহাসে নানান দিক থেকে গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বাংলায় পাল শাসন বার বার হাতছাড়া হলেও পুনরুদ্ধার করতে বেশি সময় লাগেনি। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলার ও বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয় পাল যুগেই। এই যুগই ছিলাে প্রথম বৃহত্তর সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ। বাঙালির স্বদেশ ও সৌজন্যবােধের মূল যে সামগ্রিক ঐক্যবােধ পাল সাম্রাজ্যের সময়েই গড়ে ওঠে, এটাই বাঙালি জাতীয়ত্বের ভিত্তি এবং পাল সাম্রাজের সর্বশ্রেষ্ঠ দান। পাল আমলের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ধ্রুপদী স্বাধীন যুগের শেষ হয় শুরু হয় মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ।

মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস কর্ণাটক ও দিল্লির শাসনের অধীনতা

মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার (ইংরেজি: Medieval dependent Bengal) যুগ সূচনা ঘটে ১০৭০ সাল থেকে বাংলা কর্ণাটকের সেনবংশীয়দের দ্বারা আক্রমণ থেকে। সেনদের আক্রান্ত হয়ে ১০৯৭ সালে বাংলা পরাধীন হয়ে যায় বিদেশী বিভাষী সেন রাজাদের দ্বারা। পাল আমলের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ধ্রুপদী স্বাধীন যুগের শেষ হয় এবং শুরু হয় মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ। এই মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ শেষ হয় ১৩৩৮ সালে স্বাধীন সুলতানী আমলের আরম্ভ হলে।

প্রতিবেশী কোন কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ পাল আমলে স্থলপথে বাণিজ্য-সম্বন্ধ পাতিয়ে হারানাে সমৃদ্ধি কিছুটা ফিরে পাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতেও তার কৃষির ওপর ঐকান্তিক নির্ভরতা ঘােচেনি। সেন আমলে বাংলাদেশ একেবারেই কৃষিনির্ভর, ভূমিনির্ভর, গ্রাম্য সমাজে পরিণত হল। এই পর্বে সােনা-রুপো দূরের কথা, কোন রকম ধাতুর মুদ্রাই আর দেখা যায় না। গ্রাম এবং কৃষি বাঙালীব জীবনে সর্বেসর্বা হয়ে থাকল। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের থিতিয়ে-থাকা জীবনের নিশ্চিত আর স্বাচ্ছন্দ্য, স্নিগ্ধতা আর আমেজ বাঙালীকে এমন করে পেয়ে বসল যে, বাইরের সংগ্রামময় তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ বহুবিস্তৃত জীবনের ডাক কিছুতেই তার কানে গেল না। (সুভাষ, ১৯৮) ফলশ্রুতিতে বাংলা দিল্লির সুলতানী শাসনের অধীন হয়ে পড়ে।

সেন আমলে পরাধীন বাংলা

দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে অর্থাৎ মদন পালের রাজত্ব কালে উত্তরবঙ্গ আক্রমণ করেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযােগে বিজয় সেন বঙ্গদেশ জয় করেন এবং সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর দিনাজপুরসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ। কর্ণাট দেশীয় নান্যদেব ছিলেন বিজয় সেন। উত্তরবঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে কামরুপ রাজ দূরীভূত কলিঙ্গরাজকে পরাজিত ও গৌড়ের রাজকে দ্রুত পলায়নে বাধ্য করেছিলেন। তিনি মিথিলায় তাঁর রাজ্য প্রশাসনিক প্রশাসন স্থাপন করেন।

বিজয় সেনের দ্বারা পরাজিত হন গৌড় রাজা মদন পাল। ফলে পাল রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ধর্মপাল, দেবপাল, মহীপাল ও রামপালের স্মৃতি বিজরিত শেষ চিহ্নগুলাে ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পুত্র বল্লাল সেন রাজ-ক্ষমতায় বসেন এবং পুরাে রাজ্যকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন। (১) রাঢ় (২) বরেন্দ্র (৩) বাগড়ী (৪) বঙ্গ ও (৫) মিথিলা। বল্লাল সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। এবং ১২০৫ খ্রি. পর্যন্ত শাসন করেন।

দিল্লির সুলতানি আমলে পরাধীন বাংলা

১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি বীর বখতিয়ার খিলজি যেদিন দেবকোটে আসেন সেদিন তাকে স্বাগত জানানাের লােকের অভাব ছিলাে না। কারণ দেবকোটে আসার পূর্বেই এখানাকার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ওই দিন বখত-ই-আর খলজি বিনা রক্তপাতে গৌড়রাজ দখল করতে পারেননি। কারণ রাজা লক্ষণ সেনের সৈন্য-সামন্ত যেভাবে ওত পেতে থাকতাে তা সহজে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকা সহজ ছিল না বখত-ই-আর খলজির। তিনি কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন।

যখন এ-বঙ্গের ক্ষমতায় বসার সম্ভাবনা খুব কাছে চলে এসেছে; ঠিক তখনি একটি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বখত-ই-আর খলজি। যে কৌশলে সেন সৈন্যরা বুঝতে এমনকি সেন রাজা লক্ষণ সেন বুঝতে পারেননি। খলজি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্যবসায়ীর বেশে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকেন ঠিক দুপুরবেলায়, যখন প্রাসাদের অনেকেই বুঝে উঠে আগেই বখত-ই-আর খলজি ও অনুসারী উদ্যত তরবারী রক্তে ভেসে যেতে শুরু করেছে। রাজা লক্ষণ সেনের দেহরক্ষী ও সৈন্যরা প্রতিরােধ ব্যুহ তৈরি করলেও বখত-ই-আর খলজির তরবারীতে টিকতে পারেনি। ফলে লক্ষণ সেন গােপন পথে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবকোট শহর থেকে তিনি দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর বিখ্যাত তিব্বত অভিযান শুরু করেন। তিব্বত অভিযানের পূর্বে বখতিয়ার খিলজী, শীরান খিলজী ও তাঁর ভ্রাতা আহম্মদ শীরান খিলজীকে সেনাবাহিনীর একাংশসহ জাজ নগরের (উড়িষ্যার দিকে) পাঠান। তাঁর তিব্বত অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পর্যবসিত হয় এবং দশ হাজার সমর নায়ক সৈন্যের মধ্যে মাত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে কোনাে রকমে দেবকোট ফিরে আসেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি আলী মর্দান কর্তৃক দেবকোট শহরে নিহত হন।

বাংলায় নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান রাজ্য দ্রুত পট পরিবর্তনের ফলে দিল্লীর শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কুতুব উদ্দীন আইবেক অযােধ্যার শাসনকর্তা কায়েমাজ রুমীকে লখনৌতি আক্রমণ করে খিলজী আমীরদের বিরােধ মীমাংসা করতে এবং প্রত্যেক আমীরকে ইকতায় বহাল আদেশ দেন। ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাসে কায়েমাজ রুমী শিরান খিলজীকে মাকসিদাহ ও সন্তোষ অঞ্চলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে আলী মর্দান বাংলায় আগমন করেন। ইওজ আলী মর্দানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ১২১০ খ্রিস্টাব্দে।

আলী মর্দান খিলজী অতি সহজেই লখনৌতির শাসনকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সমর্থ হন। ১২১০ খ্রিস্টাব্দে আইবেকের মৃত্যুর পর আলী মর্দান দিল্লীর সঙ্গে লখনৌতির সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং সুলতান আলাউদ্দীন আলী মর্দান খিলজী নাম ধারণ করেন। তিনি নিজ নামে খােতবা পাঠ ও মুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু স্বাধীন নরপতি হিসাবে বেশিদিন শাসন করতে পারেন নাই। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খিলজী আমীরগণ হােসান উদ্দীন ইওজের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হন। ১২১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা সুলতান আলাউদ্দীনকে হত্যা করেন এবং হােসান উদ্দীন ইওজ খিলজীকে নেতা নির্বাচন করেন। হােসান উদ্দীন ইওজ সুলতান গিয়াস উদ্দীন ইওজ খিলজী উপাধি ধারণ করে লখনৌতির সিংহাসন আরােহণ করেন। তিনি দেবকোট থেকে গৌড় বা লখনৌতির সিংহাসনে আরােহণ করেন। সামরিক কারণে ও প্রজাদের মঙ্গলের জন্য লখনৌতির সঙ্গে দেবকোটের যােগাযােগের জন্য একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরউদ্দীনের কাছে পরাজিত ও নিহত হন। অতঃপর বাংলার মুসলমান রাজ্য দিল্লীর অধীনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়। দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের রাজত্বকালে বাংলার শাসনকর্তা মুগীস উদ্দীন তুঘরল বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন তুঘরলকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলাকে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকালের জন্য বাংলা দিল্লীর অধীনস্ত প্রদেশ ছিল।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের ইতিহাস হচ্ছে পূর্ববঙ্গের জনগণের লড়াই ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস

১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর বােখরা খান নাসির উদ্দীন মাহমুদ উপাধি ধারণ করে নিজকে বাংলার স্বাধীন সুলতান ঘােষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রুকুন উদ্দীন কায়কাউস বাংলার শাসনকর্তা হন। তাঁর রাজত্বকালে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার দেবকোটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তারপর শামসউদ্দীন ফিরােজ শাহ ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁর শাসনামল ছিল এ দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য হিসাবে লক্ষনৌতির সমৃদ্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে গিয়াস উদ্দীন তুঘলক লখনৌতি আক্রমণ করেন। তিনি বাংলা জয় করে দেশটিকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করেন। তন্মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাঙলার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল লখনৌতি। তখন বাংলার এ অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন আলাউদ্দিন আলী শাহ।

স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা

মূল নিবন্ধ: স্বাধীন সুলতানী বাংলা ইলিয়াস শাহী, হাবশী এবং হোসেনশাহী শাসন

স্বাধীন সুলতানী আমলের বাংলা হচ্ছে ইলিয়াস শাহী, হাবশী এবং হোসেন শাহী শাসন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরউদ্দীন সোনারগাঁও-এ ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। এ ঘটনা ক্ষমতা দখলের নতুন ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের  জন্ম দেয় যার ফলে বাংলায় ইলিয়াসশাহী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসন বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করে যা সোয়া দুশ বছর অব্যাহত ছিল (১৩৩৮-১৫৭৬)।

১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দিল্লীর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার জন্য বাংলা স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহকে হত্যা করে বিহারের হাজী ইলিয়াস সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণা করে সমগ্র উত্তর বাংলার এবং পরে সমগ্র বাংলার উপর স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করতে সমর্থ হন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করে।

১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছয় বছর ছিল গােলযােগপূর্ণ। এ ছয় বছরে অন্তত চারজন হাবশী সুলতান বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন এবং প্রত্যেক সুলতানই নিহত হয়েছেন। ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, হত্যা ও স্থায়িত্বহীন শাসন বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করেছিল। হাবশী সুলতান শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহকে হত্যা করে হোসেনশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সিংহাসন অধিকার করেন। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে নেতৃস্থানীয় অভিজাতগণ তাকে সুলতান নির্বাচিত করে। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে হোসেনের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সালতানাতের অবসান ঘটে। মাহমুদ তখনকার বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর এক যুগের সূচনা হয়। সতেরো শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলার জনজীবনে এ অবস্থা বিরাজ করছিল। 

প্রাক-মুগল আমলে হুসেন শাহী আমল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ । বাংলাদেশে হাবশী শাসন অবসান ঘটে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহের আবির্ভাবের ফলে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। তাঁর আমলে রাজ্যের সীমানা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়, তাঁর আমলের অনেক ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং অনেক মুদ্রা ও শিলালিপির সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর প্রশাসনে তিনি অনেক হিন্দুকে উচচ রাজপদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন। তিনি ও তাঁর আমীর বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তাঁর বংশের মােট চারজন সুলতান বাংলা শাসন করেন।

মুঘল আমলের উপনিবেশিক পরাধীন বাংলা

মূল নিবন্ধ: মুঘল আমলের বাংলা হচ্ছে ২০০ বছরের দিল্লির অধীনতা

মুঘল আমলের উপনিবেশিক পরাধীন বাংলা (ইংরেজি: Bengal under Mughal Regime) হচ্ছে বাংলার ইতিহাসে স্বাধীন সুলতানি আমল পরবর্তী ২০০ বছরের উপনিবেশিক মুঘল শাসন। ১৫৩৮ থেকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের বাংলা জয় পর্যন্ত আটত্রিশ বৎসর বাংলা শাসনের ইতিহাসে আফগান বা পাঠান শাসনামল বলে পরিচিত। বাংলায় আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শের খান সূর। আফগান শক্তির পুনরুত্থানের চাপে বাংলায় হােসেন শাহী শাসনের এবং দীর্ঘ ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতানী শাসনের অবসান ঘটে।

আফগান শাসন (১৫৩৯-১৫৭৬) বাংলায় ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে মুগল বিজয়ের ফলে। প্রায় চার দশকের এই আফগান শাসন মূলত শাসনকর্তাদের মাধ্যমে এবং কররানী বংশের মাধ্যমে চালিত হয়। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই রাজমহলের নিকটে মুঘল ও আফগানদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর কাছে দাউদ পরাজিত ও বন্দি হন। মুঘল সেনাপতিরা দাউদ কররাণীকে হত্যা করে। রাজমহলের যুদ্ধের ফলে বাংলা পরাধীন হয়ে মুঘলদের অধীন হয়ে পড়ে।

বাংলার পরাধীন যুগ

১৫৭৪ থেকে ১৭২৭ পর্যন্ত মােট ৪০ জন মুঘল শাসনকর্তা বাংলাদেশ শাসন করেন। তাঁদের মধ্যে মানসিংহ (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ), ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ), শাহজাদা মুহাম্মদ শুজা (১৬৩৯-৬০ খ্রি.), মীর জুমলা (১৬৬০-৬৩ খ্রিস্টাব্দ), শায়েস্তা খান (১৬৬৪-৬৮, ১৬৭৯-৮৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-২৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। দিল্লীর দুর্বলতার দরুন মুঘল সম্রাটের নিযুক্ত সুবে বাংলার শেষ শাসনকর্তা মুর্শিদকুলী খান প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নরপতির মতাে এ দেশের শাসনকর্তা। মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-২৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর চার উত্তরাধিকারী সুজাউদ্দীন খান (১৭২৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দ), সরফরাজ খান (১৭৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দ), আলীবর্দী খান (১৭৪০-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দ) স্বাধীন নবাব ছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন ‘মুঘলরা বাংলাদেশের জন্য শান্তি ও প্রগতির এক নব যুগের সূচনা করে। এর ফলে, উত্তর-ভারত এবং উত্তর ভারতের স্থলপথের মধ্য দিয়ে যথা এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগসূত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবকালে এই যােগসূত্র এক বার ছিন্ন হয়। বাংলার শাসনকর্তারা দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করায় এ যােগসূত্র আবারও ছিন্ন হয়েছিল। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল থেকে উক্ত সাম্রাজ্যের অন্যতম সুশাসিত প্রদেশ সুবে বাংলায় অসংখ্য রাজ-কর্মচারী, পণ্ডিত, ধর্মপ্রচারক, বণিক, শিল্পী ও সৈন্যদের দলে দলে আগমন ঘটতে থাকে । ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংরেজ শাসন আমলে যে নবজাগরণ দেখা দেয় আড়াইশত বছর আগেই নিঃসন্দেহে তার ক্ষীণ সূচনা দেখা দিয়েছিল । এ সবই ছিল মুঘল যুগের শান্তির ফলে, যে ফল সত্যিকারভাবেই গৌরবজনক।’

ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগে বাংলা

১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দের বাংলায় উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই বাধলে শেষাবধি তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌলা বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। এই যুদ্ধে পরাজিত জনৈক অভিজাত কলিকাতায় ব্রিটিশদের আশ্রয়প্রার্থী হন। তাঁকে নবাবের কাছে প্রত্যপণে অস্বীকৃত হলে সিরাজদ্দৌলা প্রথমে কাসিমবাজার ও পরে কলিকাতা হঠাৎ আক্রমণে দখল করে নেন।

অতঃপর দক্ষিণ ভারতে ফরাসীদের সঙ্গে সংগ্রামে খ্যাতিপ্রাপ্ত দু’জন ব্রিটিশ সেনাপতি – ক্যাপ্টেন ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে জাহাজযােগে মাদ্রাজ থেকে বাংলায় পাঠানাে হয়। ক্লাইভ ভারতীয় মহাজন জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযােগ স্থাপন করেন এবং এদের মাধ্যমে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের সাহায্য চান আর ব্রিটিশরা জয়ী হলে তাঁকে বাংলার মসনদে বসানাের আশ্বাস দেন। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্লাইভের তিন হাজার সৈন্যের (এদের মধ্যে মাত্র ৮০০ জন ইউরােপীয়) কাছে ১৮ হাজার অশ্বারােহী ও ৫০ হাজার পদাতিক নিয়ে গঠিত নবাবের বিরাট সৈন্যবাহিনীর পরাজয় ঘটে। দিনটি ব্রিটিশদের কাছে তাদের ভারত বিজয়ের দিন হিসাবে খ্যাত হয়ে আছে।[৬]

আরো পড়ুন:  অসম বা আসাম বিস্তারবাদী ভারত অধিকৃত এক নিপীড়িত, শোষিত পরাধীন অঞ্চল

বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন (১৭৬৫-১৮৫৭ খ্রি:)

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ কর্তৃত্বের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিওয়ানী লাভের সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম অধ্যায়ের সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর ক্রমে কর্ণাটকে ফরাসি কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাণিজ্যের প্রতিযােগিতা সফলতার সঙ্গে মােকাবেলা এবং বাংলায় নবাবদের হাত হতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করে ইংরেজরা। এভাবে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমেই দিন দিন বাড়তে থাকে। বাংলার বিপুল ধন-সম্পদ একদিকে যেমন কোম্পানির উন্নতি ও অগ্রগতিতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্য স্থাপনের এক সুবর্ণ সুযােগ আসে। সুযােগের সঠিক সদ্ব্যবহার করতে ইংরেজদের জুড়ি মেলা ভার। দেশীয় রাজশক্তিগুলাের অবক্ষয় এবং পারস্পরিক বােঝাপড়ার অভাব ও অনৈক্য ইংরেজ-সাম্রাজ্যবাদের পথ প্রশস্ত করে। উপমহাদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের পথে ইংরেজদের এ সময় তিনটি প্রধান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিষ্কন্টক করেন। এরপর মারাঠা নেতাদের কলহ ও অনৈক্যের সুযােগে ইংরেজরা মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নকে ভেঙ্গে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের পথে আরও একটি বিরাট বাধা অতিক্রম করে। শেষ যে শক্তিটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ ছিল তা হলাে রণজিত সিংহের নেতৃত্বে শিখ শক্তি। কিন্তু শিখ শক্তিও ইংরেজদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসার থামাতে পারেনি। ফলে উপমহাদেশে ইংরেজগণ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়।[৭]

১৮৭৪ সালের বঙ্গভঙ্গ

১৮৭৪ সালের আগে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী ছিল মূল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা এবং ছোট নাগপুর নিয়ে গঠিত। বাঙালি অধ্যুষিত জেলা গোয়ালপাড়া, কাছাড় এবং সিলেটকে বিচ্ছিন্ন করে আসামে অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও, বঙ্গ থেকে গেছিল ব্রিটিশ ভারতের সর্বাধিক জনবহুল প্রদেশ যার আয়তন ছিল প্রায় ১,৮৯,৯০০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ। ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে অনুভূতিটি ছিল যে একক ব্যক্তির দ্বারা এই প্রদেশ পরিচালিত হওয়া প্রশাসনিকভাবে খুব সুবিধাজনক ছিল না এবং সে কারণেই সম্ভবত এই প্রদেশটির আয়তন এবং জনসংখ্যা হ্রাস করার পরিকল্পনাটি ‘আনুষ্ঠানিক’ভাবে নেয়া হয়েছিল[৮]।

প্রকৃতপক্ষে ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষের পরে স্যার স্টাফোর্ড নর্থকোট প্রশাসনিক সুবিধার্থে এবং দক্ষতার ভিত্তিতে “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর বিশাল আকার হ্রাস” করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তখন থেকেই বাংলার মানচিত্রকে আবার নতুন করে আঁকার প্রস্তাবগুলি শুরু হয়েছিল।[৯] সেই সময়ে বঙ্গ, বিহার, ওড়িশা ও আসাম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব আলাপের প্রেক্ষিতে আসামের প্রধান কমিশনারশিপ গঠনের মাধ্যমে ১৮৭৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল।

১৯৪৭-এর দেশভাগ ও বাংলা ভাগ

১৯৪৬ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বাংলা প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সুহরাওয়ার্দী । সুহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু বাংলা ভাগ চান নি। ওনারা ছিলেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে। সাথে ছিলেন আসামের আবুল হাশিম। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু শ্যামাপ্রসাদ, বৃটিশদের সাথে চক্রান্ত করে বাংলাভাগের পক্ষে রায় দেন।

মূল নিবন্ধ: ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ ছিলো তিন গণশত্রুর পারস্পরিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

সাতচল্লিশে তাে দেশভাগ হলাে, সেই যে অত্যন্ত ক্ষতিকর ও একেবারেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার জন্য দায়ি হচ্ছে তিনটি পক্ষ। প্রথম দায়ী গণহত্যা আর মানবজাতির শত্রু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। আর দায়ী অভ্যন্তরীণ গণশত্রু কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। দায়ী দু’পক্ষই, কম আর বেশি। উভয়েই ছিল অনমনীয়, ফলে ভাগ না হলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে এমন আশঙ্কা অমূলক ছিল না। 

কিন্তু মূল অপরাধ সেই ব্রিটিশেরই, অন্য কারাে নয়। আসল ঘটনাটা তারাই ঘটিয়েছে, জাতীয়তাবাদী দু’পক্ষকে এমনভাবে ক্রমাগত উস্কানি দিয়েছে যে ওই দু’পক্ষ পরস্পরের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে এবং দেশ ভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সংগে এসেছে বাংলা ভাগ।

নয়া উপনিবেশিক আমলে বাংলা

বাংলার প্রধান দুই অংশ ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবাংলায় বিভক্ত হয়। পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গ হয় ভারতের অন্তর্ভুক্ত। এইভাবে বঙ্গ নয়া উপনিবেশিক যুগে প্রবেশ করে। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে দিল্লির অধীনে এবং পূর্ববঙ্গ করাচীর অধীনে পরিণত হয়। উভয় বঙ্গের অর্থনীতি ও রাজনীতি পুঁজিবাদ অনুসারী এবং সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত থেকে যায়। ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গণযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর অভ্যুদয় ঘটে।

তথ্যসূত্র:

১. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-৩১।
২. রায়, ধনঞ্জয় ২০০৬, দিনাজপুর জেলার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৭- ৩৮
৩. রায়, নীহাররঞ্জন ১৪২০, বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), পৃষ্ঠা ৬১,  ৪১২, ৪১৩
৪. সিদ্দিকী, আশরাফ ১৯৭২, (সম্পাদনা) দিনাজপুর জেলা গেজেটিয়ার, পৃষ্ঠা ২৮-৩১
৫. শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে
৬. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৩৮৩।
৭. এ কে এম শাহনাওয়াজ, ইবন ইনাম, শরীফ উল্লাহ ভুঁইয়া. ইতিহাস দ্বিতীয় পত্র. ইউনিট ৫ “কোম্পানীর শাসন”, ঢাকা , বাংলাদেশ: বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়. প্রকাশকাল ২০১৪, পৃষ্ঠা ৯৫।
৮. R. C. Majumdar, History Of The Freedom Movement in India, Vol.2 p.3
৯৮. S. Sarkar, Swadeshi Movement In Bengal, p.9 ৯. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাঙালীর ইতিহাস, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা, জুন ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৯৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!