শ্রেণিবদ্ধকরণ হচ্ছে গ্রুপ, শ্রেণি ও স্তর অনুযায়ী জিনিসগুলি বাছাই এবং সংগঠিত করা

শ্রেণিবদ্ধকরণ বা শ্রেণীবদ্ধকরণ বা সূত্রায়ন বা জ্ঞানসূত্রায়ন (ইংরেজি: Categorization) হচ্ছে গ্রুপ, শ্রেণি, স্তর বা প্রত্যাশা অনুযায়ী জিনিসগুলি বাছাই এবং সংগঠিত করার কাজ। শ্রেণিবদ্ধকরণ হচ্ছে এমন কিছু যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণসমূহ “সঠিক ধরনের জিনিসটি দিয়ে সঠিক জিনিসটি করা”-র প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্যে বাছাইকরণ করে। এই করা বাচনিক বা অবাচনিক হতে পারে। মানুষের জন্য, মূর্ত বস্তু এবং বিমূর্ত ধারণা উভয়ই স্বীকৃতি, পার্থক্যকরণ, এবং শ্রেণীকরণের মাধ্যমে বোঝা হয়।

মানুষের জ্ঞান কতকগুলি মৌলিক ধারণা বা সূত্রের উপর নির্ভরশীল। এই ধারণাগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক, গুণ, পরিমাণ ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি বাদে আমাদের পক্ষে কোনো কিছুর জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। ‘স্থান’ ধারণার উপর নির্ভর করেই আমরা একটা বস্তুকে স্থানের অন্তর্ভুক্ত করি। আমরা বলি এই বস্তুটি অমুক স্থানে আছে। কালের ধারণা থেকে আমরা বস্তু বা ঘটনার উপর কালানুক্রম আরোপ করি। এরূপ ধারণা ব্যতীত আমাদের জ্ঞানলাভ সম্ভব নয় বলে দর্শনে এদের জ্ঞানের মূলসূত্র বা মাধ্যম বলা হয়।

জ্ঞানের জন্য যে কিছু সংখ্যক মৌল ধারণার আবশ্যক এ সত্য বিভিন্ন দেশের প্রাচীন দার্শনিকগণই জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আবিস্কার করেছেন। ভারতীয় বৈশেষিক দর্শন বস্তু, গুণ এবং ক্রিয়াকে জ্ঞানের মূলসূত্র বিবেচনা করেছে। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল জ্ঞানের এরূপ সূত্রের বিস্তৃততর বিশ্লেষণ করে এর সংখ্যা দশটি বলে স্থির করেছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট জ্ঞানসূত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন।

জ্ঞানসূত্রগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মারফত লাভ করে না। অভিজ্ঞতা-পূর্ব ধারণা হিসাবে মূল জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই থাকে। এই ভাববাদী মতের প্রধান আধুনিক ব্যাখ্যাতা হচ্ছেন কাণ্ট। জ্ঞানের সমস্যার কাণ্টীয় বিশ্লেষণ সংক্ষেপত এরূপ মানুষ চরম সত্তাকে জানতে পারে না। মানুষ চরম সত্তার বহিঃপ্রকাশকেই মাত্র জানতে পারে। এই বহিঃপ্রকাশকে মানুষ জানে স্থান, কাল, গুণ, সম্পর্ক এরূপ মৌলসূত্রের মাধ্যমে। জ্ঞানের এই সূত্রগুলি মানুষের মনে অভিজ্ঞতা-পূর্ব ভাব হিসাবে উদ্ভুহত হয়। অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের উদ্ভব নয়।

আরো পড়ুন:  জ্ঞান প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে

বস্তুবাদ জ্ঞানসূত্রগুলিকে নির্বিশেষে ধারণা বলে স্বীকার করলেও অভিজ্ঞতা-পূর্ব উদ্ভবের তত্ত্বকে অস্বীকার করে। বস্তুবাদ, বিশেষ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মানুষের জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে একটি সদা বিকাশমান দ্বন্দ্বমূলক জটিল প্রক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করে। বস্তু থেকে যেমন মানুষের বিকাশ, তেমনি মানুষেল সঙ্গে বস্তুর দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটেছে।

মানুষ বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে। বিভিন্ন বস্তু তার চেতনাকে আঘাত করে করে চেতনাকে বিকশিত করে। বিকশিত সেই চেতনা একাধিক বস্তুকে তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাদের উপর মিল-অমিলের গুণ আরোপ করে। এমভাবে যে সূত্রগুলি আজ মানুষের জ্ঞানের মূলসূত্র বা যে সূত্রগুলি মানুষজাতির জন্মগত এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলি একদিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষ লাভ করেছে। এরূপ মৌলসূত্র নির্দিষ্ট সংখ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি কিংবা চিরকালের জন্য এ সংখ্যার সীমাও স্থির হয়ে যায় নি। জ্ঞানের বিকাশমান প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে নতুনতর সূত্র অর্জন করে যাচ্ছে।

পদের বণ্টন

শ্রেণিবদ্ধকরণের প্রতিজ্ঞাতে (ইংরেজি:categorical proposition, বা categorical statement) উদ্দেশ্য এবং বিধেয়কে বন্টিত বা অবন্টিত হিসেবে ভাগ করা হয়। যুক্তিবিদ্যায় একটি যুক্তির মধ্যে বাক্যের একটি টার্ম বা পদের সংখ্যা বা ব্যাক্তার্থকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হল বাক্যের সেই পদটিকে বণ্টিত পদ বা ডিস্ট্রিবিউটেড টার্ম (ইংরেজি: Distributed Terms) বলে। অবরোহ যুক্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যুক্তির মধ্যে পদের বণ্টন এবং অ-বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক হয়।

যৌক্তিক বাক্যকে সাধারণত চারভাগে ভাগ করা হয় যথা: সার্বিক এবং বিশেষ; হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক। একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য তার উদ্দেশ্য পদকে, সার্বিক না বাচক তার উদ্দেশ্য বিধেয় উভয় পদকে, বিশেষ না বাচক কেবল তার বিধেয় পদকে বণ্টন করে। কিন্তু বিশেষ হ্যাঁ বাচক কোনো পদকেই বণ্টন করে না।

সকল মানুষ মরণশীল, এটি একটি সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য। এখানে উদ্দেশ্যপদ ‘মানুষ’ –এর সংখ্যা বা ব্যক্তার্থের সমগ্রের উপর বক্তব্যটি প্রযোজ্য বলে উদ্দেশ্য পদটি বণ্টিত। ‘কিছু মানুষ সৎ’ এটি একটি বিশেষ হ্যাঁ বাচক বাক্য। এখানে সকল মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সততার কথাটি প্রযোজ্য নয়, তেমনি সকল সৎ-এর উপরও এই বাক্যের ‘কিছু মানুষ’ পদটি প্রযোজ্য নয়। এ কারণে এই বাক্যের কোনো পদই বণ্টিত নয়। যুক্তির মধ্যে কোনো পদ বণ্টন না করে সিদ্ধান্তে তাকে বণ্টন করা হলে অবণ্টিত পদের বণ্টনজনিত ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

আরো পড়ুন:  সংক্ষিপ্ত যুক্তি বা উহ্যবাক্য-যুক্তি কি ও এর প্রাসঙ্গিকতার আলোচনা

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০২-১০৩, ১৩৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!