স্বাধীন সুলতানী আমলের বাংলা হচ্ছে ইলিয়াসশাহী, হাবশী এবং হোসেনশাহী শাসন

স্বাধীন সুলতানী আমলের বাংলা (ইংরেজি: Bengal Sultanate) হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী, হাবশী এবং হোসেন শাহী শাসন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরউদ্দীন সোনারগাঁও-এ ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। এ ঘটনা ক্ষমতা দখলের নতুন ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের  জন্ম দেয় যার ফলে বাংলায় ইলিয়াসশাহী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসন বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করে যা সোয়া দুশ বছর অব্যাহত ছিল (১৩৩৮-১৫৭৬)।

ইলিয়াসশাহী শাসন

১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দিল্লীর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার জন্য বাংলা স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহকে হত্যা করে বিহারের হাজী ইলিয়াস সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণা করে সমগ্র উত্তর বাংলার এবং পরে সমগ্র বাংলার উপর স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করতে সমর্থ হন। তাঁর আবির্ভাবের ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তিনি লখনৌতিতে ক্ষমতা দখল করে ফিরুজাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করে। সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসন আরােহণ করেন। ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিনাজপুর জেলার দেবকোটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ইলিয়াস শাহী রাজ দরবারের জনৈক আমীর রাজা গণেশ ক্ষমতা দখল করলে কয়েক বৎসরের জন্য এ রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে। তাঁর পুত্র যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দিন মােহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করে বাঙলার সিংহাসনে বসেন। রাজা গণেশ ও তার বংশধররা প্রায় ত্রিশ বছর বাংলায় রাজত্ব করেন।

জালালউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সুলতান শামসুদ্দীন আহমদ শাহ ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তাঁর দু’জন ক্রীতদাস—সাদী খান ও নাসির খান তাঁকে হত্যা করেন। ক্রীতদাসের আধিপত্য খর্ব করার জন্য অমাত্য ও সেনাধ্যক্ষরা নাসির উদ্দীন আবুল মুজাফফর মাহমুদ শাহকে। ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সিংহাসনে বসান। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মাহমুদ শাহী নামে বাংলার ইতিহাসে পরিচিত। এরপর ৪৫ বছর এই বংশের সুলতানরা এই জেলাসহ বাংলা শাসন করেন। এ দেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী যুগ একটি স্মরণীয় যুগ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ বংশ স্বাধীন সুলতানী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। দিল্লীর সংগে সম্পর্কচ্ছেদের ফলে বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশে স্বাভাবিক কারণেই দেশীয় জনগণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ বংশের সুলতানরা বাংলাকে নিজেদের দেশ বলে মনে করতেন এবং জনসাধারণও তাদেরকে নিজেদের শাসক বলে স্বাগত জানিয়েছিলাে। উচচ রাজপদে হিন্দুদের নিয়ােগ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমাদর এবং দেশীয় পণ্ডিত ও পৃষ্ঠপােষকতা ইলিয়াস শাহী শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল । সামরিক বিজয়ের চেয়ে সাংস্কৃতিক বিজয় সুসম্পন্ন করাতেই এই বংশের কৃতিত্ব ছিল সমাধিক। এদেশের সামাজিক জীবনের এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল ইলিয়াস শাহী যুগে।

আরো পড়ুন:  মুঘল আমলের পরাধীন বাংলা হচ্ছে স্বাধীন সুলতানি আমল পরবর্তী ২০০ বছরের মুঘল শাসন

হাবশী শাসন

১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছয় বছর ছিল গােলযােগপূর্ণ। নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকুন উদ্দীন বরবক শাহ প্রায় আট হাজার হাবশী ক্রীতদাস বাংলায় আমদানি করে প্রায় সকল উচচ রাজপদে তাঁদেরকে নিয়ােগ করেন। হঠাৎ অত্যধিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দরুণ তাঁরা উদ্ধত হয়ে উঠে। ফলে ক্ষমতা দখলের জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে তাঁরা লিপ্ত হয়। তাঁরা মাহমুদ শাহী বংশের শেষ সুলতান জালাল উদ্দীন ফতেহ শাহকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করে এবং হত্যাকারী হাবশী ক্রীতদাস সুলতান বরবক শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন আরােহণ করেন। প্রায় ছয় বছর বাংলাদেশে হাবশী শাসন বজায় ছিল। এ ছয় বছরে অন্তত চারজন হাবশী সুলতান বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন এবং প্রত্যেক সুলতানই নিহত হয়েছেন। ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, হত্যা ও স্থায়িত্বহীন শাসন বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করেছিল।

হোসেনশাহী শাসন

হাবশী সুলতান শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহকে হত্যা করে হোসেনশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সিংহাসন অধিকার করেন। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে নেতৃস্থানীয় অভিজাতগণ তাকে সুলতান নির্বাচিত করে। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে হোসেনের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সালতানাতের অবসান ঘটে। মাহমুদ তখনকার বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর এক যুগের সূচনা হয়। সতেরো শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলার জনজীবনে এ অবস্থা বিরাজ করছিল। 

প্রাক-মুগল আমলে হুসেন শাহী আমল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ । বাংলাদেশে হাবশী শাসন অবসান ঘটে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহের আবির্ভাবের ফলে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। তাঁর আমলে রাজ্যের সীমানা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়, তাঁর আমলের অনেক ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং অনেক মুদ্রা ও শিলালিপির সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর প্রশাসনে তিনি অনেক হিন্দুকে উচচ রাজপদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন। তিনি ও তাঁর আমীর বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তাঁর বংশের মােট চারজন সুলতান বাংলা শাসন করেন। হুসেন শাহী বংশের শাসনামলে এ জেলাসহ সমগ্র বাংলা তাঁদের শাসনাধীন ছিল।

আরো পড়ুন:  বঙ্গ দেশের পশ্চিমদিকের ভূখণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গ যা বর্তমানে দিল্লির অধীন একটি অঙ্গরাজ্য

তথ্যসূত্র:

১. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-৩১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!