রাশিয়ায় শ্রমিক পত্র-পত্রিকার ইতিহাস থেকে

[কয়েকটা অংশ]

রাশিয়ায় শ্রমিক পত্র-পত্রিকার ইতিহাস অবিচ্ছেদ্যভাবেই গণতান্ত্রিক আর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই, মুক্তির জন্যে আন্দোলনের প্রধান পর্বগুলোকে জানলে একমাত্র তবেই বোঝা সম্ভব শ্রমিক পত্র-পত্রিকার প্রস্তুতি আর উদ্ভব কেনো ঘটল একটা বিশেষ ধারায়, এবং অন্য কোনো ধারায় নয়।

রাশিয়ায় মুক্তি-আন্দোলন তিনটে প্রধান পর্বের ভিতর দিয়ে পার হয়েছে, সেগুলো রুশ সমাজের তিনটে প্রধান শ্রেণীর প্রতিষঙ্গী, এইসব শ্রেণী তাদের ছাপ ফেলে দিয়েছে এই আন্দোলনের উপর : ১) অভিজাত সম্প্রদায়ের কালপর্যায়, মোটামুটি ১৮২৫ থেকে ১৮৬১ সাল; ২) রাজনোচিনেৎস বা বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক কালপর্যায়, মোটামুটি ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সাল; ৩) প্রলেতারীয় কালপর্যায়, ১৮৯৫ সাল থেকে বর্তমান কাল। অভিজাত কালপর্যায়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন ডিসেম্বরীরা এবং গের্তসেন। ঐ সময়ে, ভূমিদাসপ্রথার আমলে সাধারণ ভূমিদাস জনগণের মধ্য থেকে, অধিকার বঞ্চিত ‘নিচের’ বর্গগুলো থেকে, ভিড়ের মধ্য থেকে একটা শ্রমিক শ্রেণীকে পৃথক করে ধরবার কোনো প্রশ্নই থাকতে পারত না। তখনকার দিনে গেৎসেনের কলোকলকে সামনে ধরে অবৈধ সাধারণ গণতান্ত্রিক পত্র-পত্রিকাই ছিল শ্রমিকদের (প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক বা সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক) পত্র-পত্রিকার অগ্রদূত।

ঠিক যেমন ডিসেম্বরীরা জাগিয়ে তুলেছিলেন গের্তসেনকে, তেমনি গের্তসেন আর ‘কলোকল’ রাজনোচিনেৎসদের জাগিয়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিলেন – এরা ছিলেন উদারপন্থী আর গণতন্ত্রী বুর্জোয়াদের শিক্ষিত প্রতিনিধি ; অভিজাত সম্প্রদায়ের নয় – এরা ছিলেন উচু সরকারী কর্মকর্তা, শহরে পেটিবুর্জোয়া, বেনিয়া এবং কৃষক শ্রেণীর মানুষ। ভূমিদাসপ্রথা লোপেরও আগে ভ, গ, বেলিনস্কিই ছিলেন রাজনোচিনেৎসদের একজন অগ্রদূত – যে-রাজনোচিনেৎসরা আমাদের মুক্তি-আন্দোলন থেকে অভিজাতদের সম্পূর্ণতই হঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিখ্যাত ‘গোগল সমীপে পত্র’[১] যাতে সারসংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছিল বেলিনস্কির[২] সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপ, সেটা ছিল অবৈধ গণতান্ত্রিক পত্র-পত্রিকাজগতের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যার বিপুল এবং প্রাণবন্ত তাৎপর্যের একটুও আজও অবধি ক্ষুণ্ণ হয় নি।

ভূমিদাসপ্রথার পতনের সঙ্গে সঙ্গে, সাধারণভাবে মুক্তি-আন্দোলনে এবং বিশেষত অবৈধ গণতান্ত্রিক পত্র-পত্রিকাজগতে কর্মের মুখ্য কর্তা হিসেবে জনগণের ভিতর থেকে দেখা দিল রাজনোচিনেৎসরা। নারোদবাদ ছিল রাজনোচিনেৎস দৃষ্টিকোণের অনুরূপ — সেটা হয়ে উঠল প্রাধান্যশালী মতধারা। সামাজিক মতধারা হিসেবে সেটা ডানে উদারপন্থা এবং বাঁয়ে নৈরাজ্যবাদ থেকে কখনও বিযুক্ত হতে পারে নি। তবে, গের্তসেনের পরে নারোদনিক মতামত বিকশিত করেছিলেন চের্নিশেভস্কি — গের্তসেনের সঙ্গে তুলনায় তিনি একটা বিরাট অগ্রপদক্ষেপ করেছিলেন। চের্নিশেভস্কি ছিলেন ঢের বেশি অবিচলিত এবং সংগ্রামী গণতন্ত্রী, তাঁর রচনাগুলিতে প্রকাশ পেত শ্রেণীসংগ্রামের মানসতা। উদারপন্থার বিশ্বাসঘাতকতা খুলে ধরার কর্মধারা ধরে তিনি চলতেন দৃঢ়ভাবে – এই কর্মধারা আজও অবধি কাদেত আর লুপ্তিপন্থীদের ঘৃণ্য। তাঁর স্বপ্নরাজ্যের সমাজতন্ত্র সত্ত্বেও তিনি ছিলেন পুঁজিবাদের একজন অসাধারণ প্রগাঢ় সমালোচক।

সপ্তম আর অষ্টম দশকে কতকগুলি অবৈধ প্রকাশনা দেখা দিয়েছিল, সেগুলি মর্মবস্তুতে ছিলো সংগ্রামী-গণতান্ত্রিক এবং স্বপ্নরাজ্যের সমাজতান্ত্রিক, ‘জনগণের মধ্যে সেগুলির প্রচার শুরু হয়েছিল। ঐ যুগের ব্যক্তিতাশালীদের মধ্যে খুবই বিশিষ্ট ছিলেন শ্রমিক পিয়ৎর আলেক্সেয়েভ[৩], স্তেপান খালতুরিন[৪], এবং অন্যান্যেরা। তবে, প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক ধারাটা নারোদবাদের মুখ্য স্রোত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি; সেটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র রুশী মার্কসবাদ মতাদর্শগত রূপধারণ করার পরে [‘শ্রম-মুক্তি’ গ্রুপ {৫}, ১৮৮৩] এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়মিত শ্রমিক আন্দোলন শুরু হবার পরে (১৮৯৫-১৮৯৬ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গের ধর্মঘট)।

রাশিয়ায় সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসি প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘শ্রম-মুক্তি’ গ্রুপ, সেটা গঠিত হয়েছিল ১৮৮৩ সালে বিদেশে। এই গ্রুপের লেখাগুলি ছাপা হতো বিদেশে, সেগুলি সেন্সর করা হত না, সর্বপ্রথমে সেগুলিতেই সমস্ত ব্যবহারিক সিদ্ধান্ত সমেত মার্কসবাদের ভাব-ধারণাগুলিকে সুসম্বদ্ধভাবে ব্যাখ্যা করা হত – একমাত্র মার্কসবাদের ভাবধারণাগুলিতেই শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন আর তার লক্ষ্যের যথার্থ সারমর্ম প্রকাশ পায়, যা দেখা গেছে সারা পৃথিবীর অভিজ্ঞতার মধ্যে। ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৫ সালের বারো বছরের মধ্যে রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পত্র-পত্রিকা প্রতিষ্ঠার কার্যত একমাত্র চেষ্টা ছিল, ১৮৮৫ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সংবাদপত্র ‘রাবোচি’র প্রকাশ; এটা অবশ্য অবৈধ ছিলো, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিল এর মাত্র দুটো সংখ্যা। শ্রমিক শ্রেণীর গণ-আন্দোলন না-থাকার ফলে শ্রমিক পত্র-পত্রিকার ব্যাপক বিকাশের কোনো সুযোগ ছিল না।

সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের অংশগ্রহণে শ্রমিক শ্রেণীর গণ-আন্দোলনের সূচনা হয় ১৮৯৫-১৮৯৬ সালে – বিখ্যাত সেন্টপিটার্সবুর্গের ধর্মঘটগুলির সময়ে। কথাটার সঠিক অর্থে শ্রমিক পত্র-পত্রিকা রাশিয়ায় দেখা দেয় ঐ সময়েই।

সব মিলিয়ে, ঐ সময়কার – অর্থাৎ, কুড়ি বছর আগেকার – শ্রমিকদের লিফলেটগুলি এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সংবাদপত্রগুলিই এখনকার শ্রমিক পত্র-পত্রিকার প্রত্যক্ষ অগ্রদূত: সেই একই কারখানার অবস্থা ‘ফাঁস করা’, ‘অর্থনীতিক সংগ্রাম সম্বন্ধে সেই একই সব রিপোর্ট, মার্কসবাদ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের করণীয় কাজগুলি নিয়ে সেই একই নীতিনিষ্ঠ আলোচনা, আর শেষে, শ্রমিক পত্র-পত্রিকাজগতে সেই একই দুটো প্রধান ধারা – মার্কসবাদী আর সুবিধাবাদী।

আজও অবধি যার সম্বন্ধে যথোপযুক্ত উপলব্ধি নেই, এমন খুবই লক্ষণীয় একটা জিনিস এই যে, রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর গণ-আন্দোলন দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে (১৮৯৫-১৮৯৬) অমনি দেখা দিল মার্কসবাদী আর সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে বিভাগ, রূপে আর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ইত্যাদিতে এই বিভাগের পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু ১৮৯৪ থেকে ১৯১৪ সাল অবধি সেটা থেকে গেছে মূলত সেই একই। সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এই বিশেষ রকমের বিভাগ আর আভ্যন্তরিক সংগ্রামের গভীরপ্রসারী। সামাজিক আর শ্রেণীগত শিকড় রয়েছে, সেটা স্পষ্টপ্রতীয়মান।

উপরে উল্লিখিত ‘রাবোচায়া মিসল’ [৬] তখনকার দিনের সুবিধাবাদী মতধারা প্রকাশ করত, সেটা ‘অর্থনীতিবাদ’ [৭] বলে পরিচিত। সেই ১৮৯৪–১৮৯৫ সালেই শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে এই মতধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর, রুশ শ্রমিকদের জাগরণের ফলে বিদেশে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক সাহিত্যের প্রস্ফুটন ঘটেছিল সেই ১৮৯৬ সালেই, সেই বিদেশে অর্থনীতিবাদীদের উদ্ভব আর সমাবেশ শেষে একটা ভাঙন ঘটিয়েছিল ১৯০০ সালের বসন্তে [অর্থাৎ, ‘ইসক্রা’ [৮] বের হবার আগে, এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছেপে বেরিয়েছিল ১৯০০ সালের একেবারে শেষে]।

আরো পড়ুন:  প্রত্যাহারপন্থার অনুগামী আর রক্ষকদের ‘কর্মপন্থা’

১৮৯৪-১৯১৪ সালের কুড়ি বছরে শ্রমিক পত্র-পত্রিকার ইতিহাস হলো রুশী মার্কসবাদ আর রুশী (কিংবা বরং সারা-রাশিয়া) সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির ভিতরে মতধারা দুটোর ইতিহাস। রাশিয়ায় শ্রমিক পত্র পত্রিকা জগতের ইতিহাস বুঝতে হলে, ঐ জগতের বিভিন্ন মুখপত্রের শুধু, নাম জানলে হয় না, নামগুলো জানাও তত দরকারী নয় – নামগুলো তো এখনকার দিনের পাঠকদের কাছে কিছুই অর্থ প্রকাশ করবে, সেগুলো তাদের শুধু, বিভ্রান্তই করবে – আরো বেশি জানা দরকার সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির বিভিন্ন অংশের মর্মবস্তু, প্রকৃতি আর মতাদর্শগত লাইন।

‘অর্থনীতিবাদীদের মুখ্য মুখপত্র ছিল ‘রাবোচায়া মিসল’ (১৮৯৭—১৯০০) আর ‘রাবোচেয়ে দেলো’[৯] (১৮৯৮–১৯০১)। ‘রাবোচেয়ে দেলো’র সম্পাদনা করতেন ব. ক্রিচেভস্কি[১০], তিনি পরে চলে গিয়েছিলেন সিণ্ডিকালিস্টদের দলে, বিশিষ্ট মেনশেভিক এবং এখন লুপ্তিপন্থী আ, মার্তিনভ[১১], আর আকিমভ[১২], এখন স্বতন্ত্র সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’, যিনি সমস্ত সারবান বিষয়ে লুপ্তিপন্থীদের সঙ্গে একমত।

‘অর্থনীতিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন প্রথমে কেবল প্লেখানভ[১৩] এবং গোটা ‘শ্রম-মুক্তি’ গ্রুপ [‘রাবোৎনিক’ [১৪] পত্রিকা, ইত্যাদি), আর পরে সে-লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল ‘ইসক্রা’ (১৯০০ থেকে ১৯০৩ সালে আগস্ট – রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় অবধি)।

‘অর্থনীতিবাদের’ বিরুদ্ধে ‘ইসক্রার’ পুর্ণাঙ্গ বিজয়ের ফলে, ১৯০৩ সালে সুবিধাবাদী-বুদ্ধিজীবিগত কর্মকৌশলের বিরুদ্ধে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রলেতারীয় কর্মকৌশলের বিজয়ের ফলে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির সদস্য শ্রেণিতে ‘সহযাত্রীদের’ সমাগম আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল; আর ইসক্রাতন্ত্রের জমিনে, তার অঙ্গ হিসেবে ‘মেনশেভিকবাদ’ রূপে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল সুবিধাবাদ।

মেনশেভিকবাদ দানা বেঁধে উঠেছিল পার্টিটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে (আগস্ট, ১৯০৩), সেটার উদ্ভব হয়েছিল ‘ইসক্রাপন্থীদের’ সংখ্যালঘু, অংশ থেকে (তারই থেকে মেনশেভিকবাদ নামটা) এবং ‘ইসক্রা’র সমস্ত সুবিধাবাদী বিরোধীদের থেকে। মেনশেভিকরা ‘অর্থনীতিবাদে ফিরে গিয়েছিল – অবশ্য সামান্য নতুনের মতো করা রূপে; যারা আন্দোলনের মধ্যে থেকে গেল সেই সমস্ত অর্থনীতিবাদী আ, মার্তিনভের নেতৃত্বে পালে-পালে গিয়ে জুটেছিল ‘মেনশেভিকদের’ কাতারে।

১৯০৩ সালে নভেম্বর মাসে নতুন সম্পাদকমণ্ডলীর পরিচালনায় প্রকাশিত নতুন ‘ইসক্রা’ হলো ‘মেনশেভিকবাদের’ মুখ্য মুখপত্র; তখন একজন অত্যুৎসাহী মেনশেভিক ত্রৎস্কি[১৫] খোলাখুলি বলেছিলেন, ‘পুরনো আর নতুন ইসক্রার মধ্যে রয়েছে একটা মস্ত ফারাক’। ‘বলশেভিকদের’ মুখ্য সংবাদপত্র ছিল ‘ভপেরিয়দ’ [১৬] আর ‘প্রলেতারি’ [১৭] (১৯০৫), এই দুটি পত্রিকা সমর্থন করত সামঞ্জস্যপূর্ণ মার্কসবাদের কর্মকৌশল, তারা বিশ্বস্ত থেকেছিল পুরনো ‘ইস্ক্রা’র প্রতি।  প্রকৃত গণসংযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং প্রলেতারিয়ান জনগণের কর্মকৌশলের একটা অভিব্যক্তি হিসেবে ১৯০৫-১৯০৭ সাল বিপ্লবের বছরগুলি – হলো সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসিতে এবং শ্রমিক পত্র পত্রিকা জগতে দুটো প্রধান মতধারার – মেনশেভিক আর বলশেভিক মতধারার — একটা পরীক্ষা। জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত আগুয়ান শ্রমিকদের ক্রিয়াকলাপ দিয়ে পথ যদি বাঁধান না হয়ে থাকত, তাহলে ১৯০৫ সালের শরৎকালে সহসা বৈধ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পত্র-পত্রিকা দেখা দিতে পারত না। ১৯০৫, ১৯০৬ আর ১৯০৭ সালের বৈধ সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পত্র-পত্রিকা ছিলো দুটো মতধারার দুটো গ্রুপের পত্র-পত্রিকা, তার কারণ হলো শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে ছিল পৃথক-পৃথক কর্মধারা – পেটিবুর্জোয়া আর প্রলেতারীয়।

বৈধ শ্রমিক পত্র-পত্রিকা দেখা দিয়েছিল ঊর্ধ্বগতি আর আপেক্ষিক ‘স্বাধীনতার’ তিনটে কালপর্যায়েই – যথা, ১৯০৫ সালের শরৎকালে [বলশেভিকদের ‘নোভায়া জিজন’ [১৮] আর মেনশেভিকদের ‘নাচালো’ [১৯] – বহু প্রকাশনের মধ্যে কেবল প্রধানের নাম বলা হলো); ১৯০৬ সালের বসন্তকালে (বলশেভিকদের প্রকাশিত ‘ভোলনা’ [২০], ‘এখো’ [২১], ইত্যাদি, আর মেনশেভিকদের প্রকাশিত ‘নায়াদনায়া দুমা’ [২২] এবং অন্যান্য; আর ১৯০৭ সালের বসন্তকালে।

ঐ সময়কার মেনশেভিক কর্মকৌশলের সারনির্যাস সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ল, মার্তভের[২৩] এই কথাগুলিতে : ‘রাজনীতিক ক্ষমতা থেকে বিত্তসম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির প্রতিক্রিয়াশীল অংশটাকে বের করে দেবার জন্যে বুর্জোয়া-উদারপন্থী গণতন্ত্রীদের চেষ্টায় আনুকুল্য করে ছাড়া সেই সংকটে প্রলেতারিয়েতের কার্যকর অংশগ্রহণের অন্য কোনো উপায়। মেনশেভিকরা দেখতে পায় নি – তবে, এই আনুকুল্য করার মধ্যে প্রলেতারিয়েতের পূর্ণে রাজনীতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা দরকার ছিল। উদারপন্থীদের ‘আনুকূল্য করার এই কর্মকৌশল কার্যক্ষেত্রে তাদের উপর শ্রমিকদের নির্ভরশীল করার শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ; কার্যক্ষেত্রে সেটা ছিল উদারপন্থী-শ্রম কর্মকৌশল। তার বিপরীতে, সেই সংকটটাকে চরমে পৌঁছে দেবার জন্যে লড়াই চালিয়ে, উদারপন্থার বিশ্বাসঘাতকতার স্বরপ খুলে ধরে, সেই বিশ্বাসঘাতকতা ব্যর্থ করার জন্যে পেটিবুর্জোয়াদের (বিশেষত গ্রামাঞ্চলের পেটিবুর্জোয়াদের) ওয়াকিবহাল এবং সমবেত করে বলশেভিকদের কর্মকৌশল বুর্জোয়া সংকটের মধ্যে প্রলেতারিয়েতের স্বাতন্ত্র নিশ্চিত করেছিল।

ঐ বছরগুলিতে (১৯০৫-১৯০৭) শ্রমিকসাধারণ বলশেভিকদের নেতৃত্ব অনুসরণ করেছিল, এটা বাস্তব ঘটনা, এবং এখনকার দিনের লুপ্তিপন্থীরা কলৎসোভ[২৪], লেভিৎস্কি[২৫] এবং অন্যান্যেরা সমেত মেনশেভিকরা নিজেরাই তা বারবার স্বীকার করেছে। বলশেভিকবাদ প্রকাশ করেছিল আন্দোলনের প্রলেতারীয় সারনির্যাস, আর আন্দোলনের সুবিধাবাদী, কূপমণ্ডুক বুদ্ধিজীবী পক্ষ ছিল মেনশেভিকবাদ।

শ্রমিক পত্র-পত্রিকাজগতে দুটো মতধারার মর্মবস্তু আর তাৎপর্যের আরও বিস্তারিত চরিত্রায়ণ আমরা এখানে দিতে পারছি নে। ঐতিহাসিক বিকাশের প্রধান-প্রধান তথ্য যথাযথভাবে তুলে ধরা এবং প্রধান ধারাগুলোকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু, আমরা করতে পারছি নে।

রাশিয়ায় শ্রমিক পত্র-পত্রিকার ইতিহাস প্রায় এক শতাব্দী দীর্ঘ হয়েছে ; প্রথমে, প্রস্তুতিমূলক, অর্থাৎ, মুক্তির জন্যে শ্রমিকদের নয়, প্রলেতারিয়ানদের নয়, সাধারণ গণতান্ত্রিক’, অর্থাৎ, বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস, আর তারপরে এর নিজস্ব কুড়ি বছরের প্রলেতারীয় আন্দোলনের ইতিহাস, প্রলেতারীয় গণতন্ত্র বা সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির ইতিহাস।

আরো পড়ুন:  Democracy and the Press Media

পৃথিবীর কোথাও প্রলেতারীয় আন্দোলন ‘সহসা’, বিশুদ্ধ শ্রেণীগত রূপে, তৈরি-জিনিস হিসেবে, যেন জুপিটারের মস্তক থেকে মিনার্ভার আবির্ভাবের [২৬] মতো দেখা দেয় নি, তেমনভাবে দেখা দিতে পারতও না। আগুয়ান শ্রমিকদের, সমস্ত শ্রেণীসচেতন শ্রমিকের দীর্ঘ সংগ্রাম আর কঠোর কাজের ভিতর দিয়েই শুধু প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীগত আন্দোলনকে সমস্ত রকমের পেটিবুর্জোয়া ভেজাল, বাধবন্ধ, সংকীর্ণতা আর বিকৃতি থেকে উদ্ধার করে সেটাকে গড়ে তোলা এবং শক্তিশালী করা সম্ভব হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী থাকে পেটিবুর্জোয়াদের পাশাপাশি, এরা জেরবার হয়ে প্রলেতারিয়েতের কাতারে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় নতুন লোক-বল যোগায়। আর রাশিয়া হলো পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে পেটিবুর্জোয়া, সবচেয়ে কুপমণ্ডক দেশ, যা সবেমাত্র এখন চলেছে বুর্জোয়া বিপ্লবের কালপর্যায়ের ভিতর দিয়ে, যে-বিপ্লব, দৃষ্টান্তস্বরূপ, বৃটেন পার হয়ে এসেছে সতের শতকে, আর ফ্রান্স – আঠার শতকে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে।

শ্রেণীসচেতন শ্রমিকেরা এখন তাদের বড় প্রিয় একটা কাজের মোকাবিলা করছে, সেটা হলো শ্রমিক পত্র-পত্রিকা চালাবার কাজ, এটাকে মজবুত ভিত্তিতে স্থাপন করে শক্তিশালী এবং বিকশিত করার কাজ — তারা রাশিয়ায় মার্কসবাদ এবং সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পত্র-পত্রিকার বিশ বছরের ইতিহাসের কথা ভুলবে না।

শ্রমিক আন্দোলনের যেসব অল্পে-ঘাবড়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী বন্ধ, সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে আভ্যন্তরিক সংগ্রাম এড়িয়ে চলতে চায়, যারা এ ব্যাপারে কোনো সংস্রব নেই বলে আকাশ-বাতাস ভরে ডাক হাঁক ছাড়ে, তারা এই আন্দোলনের ক্ষতি করছে। তারা সদুদ্দেশ্যপূর্ণ কিন্তু অকার্যকর মানুষ, তাদের হৈ চৈ অকার্যকর।

সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদের সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন করে, পেটিবুর্জোয়া জগাখিচুড়ি থেকে স্বতন্ত্র প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের উদ্ভব হলো কীভাবে তার আদ্যোপান্ত আর বিস্তৃত বিচার-বিশ্লেষণ করে – কেবল এই উপায়েই আগুয়ান শ্রমিকেরা তাদের নিজেদের শ্রেণীচেতনা এবং তাদের শ্রমিক পত্র-পত্রিকাকে নিষ্পত্তিমূলকভাবে শক্তিশালী করতে পারে।

১ নং ‘রাবোচি’,

২২ এপ্রিল, ১৯১৪[২৭]

টিকা:

১. ‘গােগল সমীপে পত্র’ – ১৮৪৭ সালে ভ. গ. বেলিনস্কির লেখা চিঠি, তাতে তিনি ধর্মের প্রতি, রুশ সমাজের বিকাশের বিষয়ে ন. ভ. গােগলের ভ্রান্ত দষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালােচনা করেন। গােগল এই সমস্ত দষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে পত্রালাপ থেকে নির্বাচিত অংশ’ নামক গ্রন্থে।

– গোগল, নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ (১৮০৯-১৮৫২) – মহান রুশ লেখক, নিজের রচনায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ভূমিদাস আমলে রাশিয়ার জমিদার আর রাজকর্মচারীদের জীবন ও রীতিনীতির ব্যঙ্গচিত্র।

২. বেলিনস্কি ভিসারিওন গ্রিগোরিয়েভিচ (১৮১১ – ১৮৪৮) – রুশ সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক, বিপ্লবী-গণতন্ত্রী।

[৩] আলেক্সেয়েভ, পিয়ৎর আলেক্সেয়েভিচ (১৮৪৯-১৮৯১) – উনিশ শতকের সত্তরের দশকের একজন খ্যাতনামা রুশ বিপ্লবী, পেশায় তাঁতি শ্রমিক। ১৮৭৫ সালে গ্রেপ্তার হন। ১৮৭৭ সালে আদালতে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে ভবিষৎবাণী করে বলেন যে, জার স্বৈরতন্ত্রের পতন অনিবার্য।

[৪] খালতুরিন, স্তেপান নিকোলায়েভিচ (১৮৫৬-১৮৮২) – রুশ বিপ্লবী, শ্রমিক, ১৯৭৮ সালে গড়েন ‘রুশ শ্রমিকদের উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়ন’ নামক রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবী রাজনীতিক শ্রমিক সংগঠনগুলির একটি।

৫. ‘শ্রম-মুক্তি’ গ্রুপ – প্রথম রুশ মার্কসবাদী গ্রুপ, ১৮৮৩ সালে জেনেভায় (সুইজারল্যান্ড) তা প্রতিষ্ঠা করেন গ. ভ. প্লেখানভ; রুশ সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস (১৯০৩ সাল) পর্যন্ত টিকে থাকে। রাশিয়ায় মার্কসবাদ প্রচারের কাজে গ্রুপটির অবদান অতি বিপুল। গ. ভ. প্লেখানভ ও গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠাতাদের রচনা রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন, বিদেশে তা ছাপান ও গােপনে রাশিয়ায় প্রচার করেন। গ্রুপটি নারােদবাদের উপর চরম আঘাত হানে।

৬. “রাবােচায়া মিসল’’ (‘শ্রমিকের চিন্তা’) – সংবাদপত্র, অর্থনীতিবাদীদের মুখপত্র, বেরােয় ১৮৯৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯০৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত।

৭. অর্থনীতিবাদ –১৯শ শতকের শেষ ও ২০তম শতকের গােড়ায় রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাসির অভ্যন্তরস্থ একটি সুবিধাবাদী ধারা। অর্থনীতিবাদীরা মনে করে যে, শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধি, শ্রমাবস্থার উন্নতি ইত্যাদির আর্থনীতিক সংগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত, জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনীতিক সংগ্রামটা হলো উদারনীতিক বুর্জোয়ার কাজ। শ্রমিক আন্দোলনে পার্টির নেতৃভূমিকা ও বৈপ্লবিক তত্ত্বের গুরুত্ব অস্বীকার করে ‘অর্থনীতিবাদীরা’ বলত, শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ হওয়া উচিত একমাত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ‘অর্থনীতিবাদীদের’ দষ্টিভঙ্গির একান্ত অযৌক্তিকতা ও ক্ষতিকরতা লেনিন দেখান তাঁর “কী করতে হবে ?” বইটিতে।

৮. ‘ইসক্রা’ (স্ফুলিঙ্গ), ১৯০০ সালে লেনিন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম সারা রুশ অবৈধ মার্কসবাদী পত্রিকা, বেরােয় বিদেশে। রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি গঠনে পত্রিকাটি নির্ধারক ভূমিকা নেয়। পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরেই (১৯০৩) মেনশেভিকরা ‘ইসক্রা’ দখল করে বসে। ৫২ নং সংখ্যা থেকে ‘ইস্ক্রা’ আর বিপ্লবী মার্কসবাদের মুখপত্র থাকে না। লেনিন ‘নতুন’ মেনশেভিক ‘ইস্ক্রার’ কথা বলছেন না, তিনি বােঝাতে চেয়েছেন ‘পুরনো’ বৈপ্লবিক ‘ইসক্রা’।

৯. “রাবোচেয়ে দেলাে’ (‘শ্রমিকের কর্মযজ্ঞ’) – পত্রিকা, ‘প্রবাসী রুশ সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটদের সঙেঘ’র মুখপত্র, বেরয় জেনেভায় ১৮৯৯ সালের এপ্রিল থেকে ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। রাববাচেয়ে দেলাে’র সম্পাদকমণ্ডলী ছিল ‘অর্থনীতিবাদীদের বিদেশী কেন্দ্র।

[১০] ক্রিচেভস্কি, ব. ন. (১৮৬৬ – ১৯১৯) – সমাজ-গণতন্ত্রী, ‘অর্থনীতিবাদের’ অন্যতম নেতা।

[১১] মার্তিনভ, আলেক্সান্দর সামোইলভিচ (১৮৬৫-১৯৩৫) – রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাট, উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে অর্থনীতিবাদের সমর্থক, পরে মেনশেভিক।

[১২] আকিমভ, (মাখনোভেৎস) ভ. প. (১৮৭২-১৯২১) – সোশ্যাল ডেমোক্রাট, ‘অর্থনীতিবাদের’ বিশিষ্ট প্রতিনিধি, চরম সুবিধাবাদী। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯০৩) পর সক্রিয় মেনশেভিক।

[১৩] প্লেখানভ, গেওর্গি ভালেন্তিনোভিচ (১৮৫৬-১৯১৮) – রুশ ও আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক শ্রমিক আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী, মার্কসবাদের খ্যাতনামা প্রচারক। ১৯০৩ সাল থেকে মেনশেভিক।

আরো পড়ুন:  ল. ন. তলস্তয় এবং সমসাময়িক শ্রমিক আন্দোলন

১৪. ‘রাবোৎনিক’ (‘পরিশ্রমী’) – অনিয়মিত প্রবন্ধ-সংকলন, প্রবাসী রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটদের সঙ্ঘে’র প্রকাশন, বিদেশে বেরয় ১৮৯৬–১৮৯৯ সালে ‘শ্রম-মুক্তি’ গ্রপের সম্পাদনায়। রাবােৎনিক’ প্রকাশের ব্যাপারে উদ্যোক্তা ছিলেন ভ. ই. লেনিন।

[১৫] ত্রতস্কি (ব্রনস্টেইন) ল. দ. (১৮৭৯-১৯৪০) – লেনিনবাদের জঘন্যতম শত্রু। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে সাইবেরীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি, ইসক্রাপন্থী-মেনশেভিক; কংগ্রেসের পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সমস্ত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রশ্নে বলশেভিক পার্টির বিরুদ্ধে নির্মম সংগ্রাম চালান। প্রতিক্রিয়া (১৯০৭-১৯১০) ও নতুন বৈপ্লবিক জোয়ারের বছরগুলিতে ‘নির্দলীয়তার’ ভেক নেন, যদিও আসলে লুপ্তিপন্থার মতাবলম্বন করেন। ১৯১৭ সালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির (বলশেভিক) ষষ্ঠ কংগ্রেসে বলশেভিক পার্টিতে গৃহীত হন, কিন্তু বলশেভিকদের আদর্শকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর একাধিক দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, সমাজতন্ত্র নির্মাণের লেনিনীয় কর্মসূচির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান, প্রচার করেন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় অসম্ভব। কমিউনিস্ট পার্টি পেটিবুর্জোয়া বিচ্যুতি হিসেবে ত্রতস্কিপন্থার মুখোশ ফাঁস করে দেয়, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিকভাবে ওটাকে বিধ্বস্ত করে। ১৯২৭ সালে ত্রতস্কি পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন, ১৯২৯ সালে সোভিয়েত-বিরোধী ক্রিয়াকলাপের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নির্বাসিত ও ১৯৩২ সালে সোভিয়েত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

১৬. ‘ভপেরিয়দ’ (‘আগুয়ান’) – অবৈধ বলশেভিক সংবাদপত্র; প্রকাশিত হয় জেনেভায় ১৯০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর (১৯০৫ সালের ৪ জানুয়ারি) থেকে ১৯০৫ সালের ৬ (১৯) মে পর্যন্ত। সর্বসমেত বেরয় ১৮টি সংখ্যা। সংবাদপত্রের সংগঠক, ভাবাদর্শগত উৎসাহদাতা আর নেতা ছিলেন ভ. ই. লেনিন। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন ভ. ভ. ভরােভস্কি, ম. স. ওলমিনস্কি ও আ. ভ. লুনাচারস্কি।

১৭. ‘প্রলেতারি’ (‘প্রলেতারিয়ান’) – অবৈধ বলশেভিক সাপ্তাহিক পত্রিকা, রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র, পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্থাপিত; প্রকাশিত হয় জেনেভায় ১৯০৫ সালের ১৪ (২৭) মে থেকে ১৩ (২৬) নভেম্বর পর্যন্ত। পত্রিকাটির সম্পাদনা করতেন ভ. ই. লেনিন। ২৬টি সংখ্যা বেরােয়, লেনিন রাশিয়ায় চলে আসার পর শেষের সংখ্যাগুলাে সম্পাদনা করেন ভ. ভ. ভরােভস্কি।

১৮. ‘নােভায়া জিজন’ (‘নব জীবন’) – বলশেভিকদের প্রথম বৈধ সংবাদপত্র; বেরয় পিটার্সবুর্গে ১৯০৫ সালের ২৭ অক্টোবর (৯ নভেম্বর) থেকে ৪ (১৬) ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯০৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে বিদেশ থেকে ভ. ই. লেনিনের পিটার্সবুর্গে প্রত্যাবর্তনের পর সংবাদপত্রটি তাঁর সরাসরি নেতৃত্বে প্রকাশিত হতে থাকে। ‘নােভায়া জিজন’ বস্তুত রুশ সোশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ছিল। আ. ম. গাের্কি সংবাদপত্রটিতে সক্রিয় অংশ নিতেন, তিনি ‘নােভায়া জিজন’কে যথেষ্ট বৈষয়িক সাহায্যও দিয়েছেন। ‘নােভায়া জিজন’ ছিল রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সমস্ত সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপের সক্রিয় পথপ্রদর্শক।

১৯. ‘নাচালাে’ (শুরু) – মেনশেভিকদের দৈনিক বৈধ সংবাদপত্র; বেরয় পিটার্সবুর্গে ১৯০৫ সালের নভেম্বরে-ডিসেম্বরে।

২০. “ভােলনা” (‘তরঙ্গ’) – দৈনিক বলশেভিক বৈধ সংবাদপত্র; প্রকাশিত হয় পিটার্সবুর্গে ১৯০৬ সালের ২৬ এপ্রিল (৯ মে) থেকে ২৪ মে (৬ জুন) পর্যন্ত; মােট ২৫টি সংখ্যা বেরয়। নবম সংখ্যা [৫ (১৮) মে, ১৯০৬] থেকে শুরু করে ভ. ই. লেনিনই বস্তুত সংবাদপত্রটি সম্পাদনা করেন। সম্পাদনার কাজে অংশ নেন ভ. ভ, ভরােভস্কি ও ম. স. ওলমিনস্কি। শিগগিরই সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে পুলিসের উৎপাত শুরু হয় এবং সরকার তা বন্ধ করে দেয়। ভােলনা’র বদলে বেরােতে লাগল বলশেভিকদের বৈধ সংবাদপত্র ‘ভপেরিষদ’।

২১. ‘এখাে’ (‘প্রতিধ্বনি’) – বলশেভিক বৈধ দৈনিক সংবাদপত্র, বেরয় পিটার্সবুর্গে ১৯০৬ সালের ২২ জন (৫ জুলাই) থেকে ৭(২০) জুলাই পর্যন্ত। এটি বেরয় সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া ‘ভপেরিয়দ সংবাদপত্রের বদলে। প্রকাশিত হয় মােট ১৪টি সংখ্যা। বস্তুত ভ. ই. লেনিনই ছিলেন তার সম্পাদক। প্রতি সংখ্যায়ই লেনিনের প্রবন্ধাদি থাকত। প্রথম রাষ্ট্রীয় দুমাে ভেঙ্গে দেবার আগে সংবাদপত্রটি বন্ধ হয়ে যায়।

২২. ‘নারোদনায়া দুমা’ (‘জনগণের বিধানসভা’) – দৈনিক মেনশেভিক সংবাদপত্র; বেরয় পিটার্সবুর্গে ১৯০৭ সালের মার্চে-এপ্রিলে।

২৩. মার্তভ ল. (সেদেরবাউম, ইউ. ও., ল. ম.) (১৮৭৩ – ১৯২৩) – মেনশেভিকবাদের অন্যতম নেতা। প্রতিক্রিয়া (১৯০৭-১৯১০) ও নতুন বৈপ্লবিক জোয়ারের বছরগুলিতে লুপ্তিপন্থী।

২৪. কলৎসোভ, দ. (গিঞ্জবুর্গ, র. আ.; ল. স.; সেদোভ, ল.) (১৮৬৩-১৯২০) -সোশ্যাল ডেমোক্রাট, রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯০৩) পর সক্রিয় মেনশেভিক, একাধিক মেনশেভিক প্রকাশনের লেখক প্রতিক্রিয়াশীলতা (১৯০৭-১৯১০) ও নতুন বৈপ্লবিক জোয়ারের বছরগুলোতে লুপ্তিপন্থার অবস্থানে ছিলেন।

২৫. লেভিৎস্কি, ভ. (সেদেরবাউম, ভ. ও.) (জন্ম ১৮৮৩) – সোশ্যাল ডেমোক্রাট, মেনশেভিক। প্রতিক্রিয়াশীলতা (১৯০৭-১৯১০) ও নতুন বৈপ্লবিক জোয়ারের বছরগুলোতে লুপ্তিপন্থার অন্যতম নেতা।

২৬. জুপিটার ও মিনার্ভা – প্রাচীন রােমক দেবতা। জুপিটার – আকাশ ও বজ্রের দেবতা; রােমের মহাদেব। মিনার্ভা – যুদ্ধের দেবী, কারুকর্ম, বিজ্ঞান ও শিল্পের রক্ষাকত্রী; অতিকথা অনুসারে, মিনার্ভার জন্ম হয় জুপিটারের মাথা থেকে।

২৭. লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৬৪-৭২ থেকে এই লেখাটি রোদ্দুরে ডট কমে সংকলন করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!