কমিউনিস্ট ইশতেহারের ১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের ভূমিকা

‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এর প্রথম রুশ সংস্করণ, বাকুনিনের অনুবাদে, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে[১] “কলোকোল’[২] পত্রিকার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন পশ্চিমের কাছে এটা (‘ইশতেহার’—এর রুশ সংস্করণ) মনে হতে পারত একটা সাহিত্যিক কৌতুহলের বিষয় মাত্র। আজ তেমনভাবে দেখা অসম্ভব।

তখনও পর্যন্ত (ডিসেম্বর, ১৮৪৭) প্রলেতারিায় আন্দোলন কত সীমাবদ্ধ স্থান জুড়ে ছিলে, সে কথা সবচেয়ে পরিষ্কার করে দেয় ‘ইশতেহার’’-এর ‘বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধী পার্টির সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান’ শীৰ্ষক শেষ অধ্যায়টি, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখই নেই এখানে। সে যুগে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরাট শেষ আশ্রয়স্থল এবং যুক্তরাষ্ট্র টেনে নিচ্ছিল ইউরোপিয় প্রলেতারিয়েতের উদ্ধৃত্তি অংশটাকে অভিবাসনের মধ্য দিয়ে। উভয় দেশই ইউরোপকে কাঁচামাল যোগাত, আর সেইসঙ্গে ছিলো তার শিল্পজাত সামগ্রীর বিক্রয়ের বাজার। সে যুগে তাই দুই দেশই কোনো না কোনোভাবে ছিল ইউরোপের চলতি ব্যবস্থার স্তম্ভ।

আজ অবস্থা কত বদলে গেছে! ইউরোপিয়দের অভিবাসনের দরুনই উত্তর আমেরিকা বৃহৎ কৃষি-উৎপাদনের যোগ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তার প্রতিযোগিতা ইউরোপের ছোটো বড়ো সমস্ত ভূসম্পত্তির ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে। তা ছাড়া এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিপুল শিল্পসম্পদকে এমন শক্তি দিয়ে ও এমন আয়তনে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে যে শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের, বিশেষ করে ইংলন্ডের যে একচেটিয়া অধিকার আজও বজায় রয়েছে, তা অচিরে ভেঙে পড়তে বাধ্য। উভয় পরিস্থিতি খোদ আমেরিকার উপরেই বিপ্লবী উপায়ে প্রতিক্রিয়া করে। গোটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তিতে যে কৃষকের ছোটো ও মাঝারি ভূসম্পত্তি ছিলো, তা ক্ৰমে ক্ৰমে বৃহদায়তন খামারের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে পড়ছে, সেইসঙ্গে শিল্পাঞ্চলে এই প্রথম ঘটছে প্রচুর সংখ্যায় প্রলেতারিয়েত ও অবিশ্বাস্যভাবে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের বিকাশ।

আর এখন রাশিয়া ! ১৮৪৮-১৮৪৯ সালের বিপ্লবের সময়ে শুধু ইউরোপিয় রাজন্যবর্গ নয়, ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণি পর্যন্ত সদ্যজাগরণোন্মুখ প্রলেতারিয়েতের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় দেখেছিলো রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। জারকে ঘোষণা করা হয়েছিলো ইউরোপে প্ৰতিক্রিয়ার প্রধান সর্দার বলে। সেই জার আজ বিপ্লবের কাছে গাৎচিনায় যুদ্ধবন্দি[৩], আর ইউরোপে বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া।

আরো পড়ুন:  প্রগতিশীলবাদ সমাজবিপ্লবে অগ্রণী শ্রেণির সেই মতবাদ যাতে সমাজ বিপ্লবের পক্ষ অবলম্বন করা হয়

আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবাৰ্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা ঘোষণা করাই ছিলো ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’—এর লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়াতে দেখি, দ্রুত বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী জুয়াচুরি ও বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া ভূসম্পত্তির মুখোমুখি রয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি জমি জুড়ে চাষিদের যৌথ মালিকানা। এখন প্রশ্ন হল, অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেলেও জমির উপর যৌথ মালিকানার আদি রূপ এই রুশ অবশ্চিনা (obshchina)[৪] কি কমিউনিস্ট সাধারণ মালিকানার উচ্চতর পর্যায়ে সরাসরি রূপান্তরিত হতে পারে? না কি পক্ষান্তরে তাকেও প্রথমে যেতে হবে ভাঙনের সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যা পশ্চিমের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে?

এর একমাত্র যে-উত্তর দেওয়া আজ সম্ভব তা এই: রাশিয়ার বিপ্লব যদি পশ্চিমে প্রলেতারিয় বিপ্লবের সংকেত হয়ে ওঠে যাতে দুই বিপ্লব পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে রাশিয়ার ভূমির বর্তমান যৌথ মালিকানা কাজে লাগতে পারে কমিউনিস্ট বিকাশের সূত্রপাত হিসেবে।

কার্ল মার্কস, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস

লন্ডন, ২১ জানুয়ারি, ১৮৮২

টিকা:

১. এই সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এর রুশ অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার তারিখটিও ১৮৮৮-র ইংরেজি সংস্করণে বেঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে।
২. “কলোকোল’ (ঘণ্টা) – ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত আ. ই. হের্তসেন ও ন. প. ওগারিয়োভ কর্তৃক প্রকাশিত রুশ বৈপ্লবিক-গণতান্ত্রিক সংবাদপত্র। এটি ছাপা হয় লন্ডনে (১৮৫৭-১৮৬৫) তারপর জেনেভায় (১৮৬৫-১৮৬৭)।
৩. ১ মার্চ, ১৮৮১-তে ‘নারোদনায়া ভোলিয়ার’ সদস্যদের হাতে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের প্রাণনাশের পর রাশিয়ার পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। বৈপ্লবিক গোলযোগ আর ‘নারোদনায়া ভোলিয়া’ (জনগণের সংকল্প) সংগঠনের (সন্ত্রাসবাদী নারোদনিকদের গুপ্ত রাজনৈতিক সমিতি) আরও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ভয়ে তার উত্তরাধিকারী তৃতীয় আলেকজান্ডার গাৎচিনায় চলে যান।
৪. অবশ্চিনা: স্বশাসিত গ্রামীণ সমাজ।

কমিউনিস্ট ইশতেহারের সূচিপত্র
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯২ সালের পোলীয় সংস্করণের ভূমিকা
১৮৯৩ সালের ইতালীয় সংস্করণের ভূমিকা
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
১. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত
২. প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টগণ
৩. সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
(১) প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র
ক. সামন্ত সমাজতন্ত্র
খ. পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
গ. জার্মান অথবা “খাঁটি” সমাজতন্ত্র
(২) রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
(৩) সমালোচনী — কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম
৪. বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ
টীকা

আরো পড়ুন:  পার্টি কমিটির নেতৃত্ব

Leave a Comment

error: Content is protected !!