প্রাচীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর সময়

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস বা বাংলায় প্রাচীন যুগের ইতিহাস (ইংরেজি: History of Ancient Bangla) হচ্ছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর সময়ের বাংলা অঞ্চলের লিখিত ইতিহাস। সাধারণত ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী আগের সময় থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীকেই প্রাচীনকাল বা যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে এই সময়ের মধ্যে তারতম্যও লক্ষ করা যায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাবের কার্যকারিতা নিয়েই এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

অস্ট্রিকরাই এখানে কৃষি ও পশুপালনের সূচনা করেছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি জনগােষ্ঠী অস্ট্রিকদের বংশধর। দ্রাবিড়গণ গঙ্গা তীরবর্তী বাংলা অব্দের পরে এই সংখ্যা উল্লেখযােগ্য সংখ্যক হারে বাড়তে থাকে।[১]

বৃহত্তর কোম সমাজই দলবদ্ধ প্রথম সমাজ

প্রাচীন বাংলায় কোম বা কৌম বা গোত্রই (ইংরেজি: tribe) হচ্ছে সুসংগঠিত প্রথম দলবদ্ধ সমাজ। বিভিন্ন নরগােষ্ঠী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোম জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কোমগুলাে একের সঙ্গে অন্যের যােগাযােগ ও আদানপ্রদান তেমন ছিল না। নানা ধরনের বাধা, বিধিনিষেধ ছিল। বিচিত্র এসব কোমের মধ্যে বৃহত্তর কোনাে বােধ প্রাথমিক স্তুরে গড়ে উঠেনি। কোমবদ্ধ সমাজে নিজস্ব সীমিত ভাষা ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল। কোমগুলাের সভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থা ছিল একান্তই আদিম এবং গ্রামীণ। আদিতে শিকার, কোম কৃষি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্পই ছিল সামাজিক সম্পদের প্রধান উৎস। তখন অবশ্য ধনসাম্য প্রথা কার্যকর ছিল। এর অর্থ হচ্ছে শিকার, কৃষি ও গৃহশিল্পে কোমের সদস্যরা ভাগাভাগি (ক্ষুধা নিবারণের জন্য যতটুকু প্রয়ােজন) করে নিত।

অবশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক আদান-প্রদান রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ছােট-বড় কোমের সমবায়ে বৃহত্তর কোমের (বঙ্গ, সুম্ম, পুণ্ড্র, কলিঙ্গ, রাঢ় ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটেছে। এর ফলে বাংলার সমাজে যেসব জনপদ’ পরিচয়ে প্রাচীন বিশেষ ধরনের ছােট ছােট আদি রাষ্ট্রে উদ্ভব ঘটেছিল তা বঙ্গীয় প্রাচীন সমাজকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করেছে। কোম যুগের তুলনায় উন্নত কৃষি, গৃহশিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য এতে গড়ে উঠেছে। ফলে প্রাচীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোমগােষ্ঠী ক্রমেই বৃহত্তর শংকর বাঙালি জাতিগােষ্ঠীর উদ্ভব ও বিস্তার ঘটায় বাংলাদেশ ভুখন্ডে।

জনপদগুলাের সমাজব্যবস্থা

প্রাচীন জনপদগুলাের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায় না। সে কারণে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া কষ্টকর। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, জনপদগুলাে ছিল মূলত কৃষিপ্রধান। তবে এগুলােতে গৃহশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও উদ্ভব ঘটেছিল। জনপদগুলােতে রাষ্ট্রের কিছু দায়বদ্ধতা লক্ষ করা যায়। যেমন, দুর্ভিক্ষ হলে রাষ্ট্র বা রাজা-মহাধিরাজাগণ জনকল্যাণের চিল্প থেকে রাজকীয় শস্যভান্ডার থেকে ফসল, শস্যবীজ বিলিয়ে দিত বলে জানা যায়। তবে তা থেকে এটাও আবার মনে করা যায় যে, অভাব ও দুর্ভিক্ষ প্রাচীন জনপদগুলােতে কমবেশি ছিল।

মৌর্য যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-১৮৫ অব্দ) বাংলা

মৌর্যদের পরিচয় ও মৌর্য যুগ 

সমগ্র ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে যায়। খন্ড খন্ড ভারতবর্ষ রূপান্তরিত হয় সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে। আদি কৌম (গােত্রীয়) সমাজ রূপান্তরিত হয় সামাজ্যে। ঐ চতুর্থ শতাব্দীতে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে) মহান আলেকজান্ডার মেসিডােনিয়া থেকে ভারত আক্রমণ করেন। বর্তমান উড়িষ্যাকে তখন মগধ বলা হতাে। পাটলিপুত্র এর রাজধানী ছিল। মগধের সম্রাট ধননন্দ ছিলেন নন্দবংশীয়। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যাচারী রাজা। তাকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে পরাজিত করেন। চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের আক্রমণ শুধু প্রতিহত নয়, তাদেরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করেন। তার নামানুসারে ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা মৌর্য সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। 

আরো পড়ুন:  মুঘল আমলের পরাধীন বাংলা হচ্ছে স্বাধীন সুলতানি আমল পরবর্তী ২০০ বছরের মুঘল শাসন

বাংলায় মৌর্য শাসন

মৌর্য বংশের শাসকরা বঙ্গ ও মগধ প্রদেশে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাদেশ দ্রুত মৌর্য শাসন কবলিত হয়। মৌর্যদের পরাজিত করার মত শক্তিশালী কোনাে রাজবাহিনী তখন বাংলায় ছিল না। তবে গ্রিক লেখকদের বর্ণনায় আলােকজান্ডার যখন (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) ভারত আক্রমণ করেন তখন বাংলাদেশ ভূখন্ডে গংগরিডাই নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল। এখানে পরাক্রমশালী একজন রাজা ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। সেই রাজার ৪ হাজার হাতিসহ একটি সুসজ্জিত বিরাট বাহিনী ছিল। গ্রিক লেখকদের বর্ণনায় ঐ রাজ্যের রাজধানী নদী উপকূলবর্তী গংগ নামে একটি বন্দর নগরের কথা উলে-খ করা হয়েছে। তাদের লেখা থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যড় গংগারিডাই রাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে গংগরিডাই রাজ্য হচ্ছে বঙ্গ রাজ্য। গ্রিক লেখকরা গংগরিডাই উচ্চারণে তা বুঝেছেন। 

বাংলার আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা

মৌর্য রাজবংশ চন্দ্রগুপ্তের (৩২১-২৯৮ খ্রিস্টপূর্ব) হাত দিয়ে শুরু হলেও তার পুত্র বিন্দুসার (খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮-২৭৩) এবং বিন্দুসারের পুত্র অশােকের (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দে) শাসনামলে সাম্রাজ্য চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অব্দে অশােকের মৃত্যু পর্যড় ৪০ বছর তিনি ভারতবর্ষে রাজত্ব করেন। সম্রাট অশােকের রাজত্বকালে প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্য মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্ভুক্ত হয়। ঐ সময় মগধ (পাটলিপুত্র-রাজধানী) এবং গংগারিডাই মিলে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। পুন্ড্রনগরের রাষ্ট্রভান্ডার মুদ্রা ও শস্যে পরিপূর্ণ ছিল বলে দাবি করা হয়। তবে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের দেয়া বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের বীজ ও খাদ্য বিতরণ করা হতাে। তাতেই মনে হয়, প্রাচীন বাংলার পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলেও প্রাচুর্য এবং অভাব দুটোই ছিল। তবে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন যে, মৌর্য যুগে বাংলা ছিল ঐশ্বর্যপূর্ণ। বাংলায় মসৃণ সূতিকাপড় তৈরি হতাে, এসব কাপড় পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতাে। ম্রাট অশােকের মৃত্যুর পর মৌর্যবংশ দুর্বল হতে থাকে। ঐ বংশের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। 

গুপ্ত যুগে বাংলা

গুপ্ত যুগ ও শাসনের পরিচয়

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর দীর্ঘদিন অর্থাৎ প্রায় পাঁচশ বছর কোনাে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা বাংলায় ছিল না। খ্রিস্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩২০-৩৩৫ খ্রি.), তার পুত্র সমুদ্র গুপ্ত (৩৩৫-৩৮০ খ্রি.), পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৩ খ্রি.) ভারতে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় বাংলায় কতগুলাে স্বাধীন রাজ্য অবস্থান করছিল। এসবের মধ্যে পুষ্করণ, সমতট, বঙ্গ, ডবাক, পুন্ড্রবর্ধন বিশেষভাবে উলে-খযােগ্য। পুষ্করণ রাজ্যটি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া থেকে ফরিদপুরের কোটালিপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ রাজ্যের অধিপতি সিংহবর্মা এবং তার পুত্র চন্দ্রবর্মার নাম খােদাই করা লিপিতে উল্লেখ আছে। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত চন্দ্রবর্মাকে পরাজিত করে পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলা অধিকার করেন। বাংলাদেশের পূর্বভাগ ও সমতট সমুদ্র গুপ্তের করদরাজ্য ছিল। সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপিতে বর্তমান আসাম (কামরুপ) গুপ্ত সাম্রাজ্যের করদরাজ্য রূপে উল্লেখ আছে। ‘ডবাক’ রাজ্যের পরিচয় সম্পর্কে কেউ কেউ ঢাকা শহরের প্রাচীন নাম বলে উল্লেখ করেছেন, তবে আসামের কপিলা নদীর উপত্যকায় ‘ডবােক’ থেকে অন্যরা এটিকে গুপ্ত যুগের ‘ডবাক’ বলে মনে করেন। এছাড়া সমতট জনপদও গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্ভুক্ত হয়ে পড়ায় ধারণা করা হচ্ছে যে পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাচীন বাংলার বেশির ভাগই ঐ সামাজ্যের অংশ ছিল। গুপ্ত সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত শাসনকর্তাগণ পুন্ড্রবর্ধন নামক বিভাগ থেকে শাসন করতেন। এমনকি ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত বংশের সম্রাটের নিজ পুত্র এখানকার শাসনকর্তা রূপে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন।

আরো পড়ুন:  বঙ্গ দেশের পশ্চিমদিকের ভূখণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গ যা বর্তমানে দিল্লির অধীন একটি অঙ্গরাজ্য

আবার ৫০৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত পূর্ববঙ্গ তথা সমতটের শাসক ছিলেন বলে জানা যায়। প্রথমে তিনি দক্ষিণপূর্ব বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন, পরে স্বাধীন রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। বৈন্যগুপ্তের রাজধানী ছিল ক্রীপুর। বৈন্যগুপ্তের নামে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

গুপ্ত শাসনব্যবস্থা 

গুপ্ত সম্রাটগণ বাংলাকে শাসন করার সুবিধার্থে কতগুলাে ভাগে বিভক্ত করেন। ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মূল’, ‘বীথি’ ও ‘গ্রাম’ নামে এসব প্রশাসনিক ভাগ ছিল। ‘ভুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক বিভাগ। সম্রাটের একজন প্রতিনিধি এ সব ‘ভুক্তির শাসনকর্তা ছিলেন। তেমন দুটি ভুক্তি হচ্ছে পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি (উত্তর বঙ্গ) ও বর্ধমান (প্রাচীন রাঢ়ের দক্ষিণাংশ)। ভুক্তির পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগের নাম ‘বিষয়’। এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম বিভাগ। বর্তমান কালের জেলার সঙ্গে এর গুরুত্ব তুলনা করা যায়। বিষয়ের শাসনকর্তাদের ‘আযুক্তক’, কোথাও ‘বিষয়পতি’ বলা হতাে। ভুক্তির শাসনকর্তাই তাদের নিয়ােগ দিতেন। উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে-‘কোটিবর্ষ বিষয়’, ‘খােদাপাড়া বিষয়’, ‘পঞ্চনগরী বিষয়’, ‘বরাকমন্ডল বিষয় ইত্যাদি। তবে ‘বিষয় তথা জেলা প্রশাসনে বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন উপদেষ্টামন্ডলী ছিল। তারা দলিলরক্ষক, নগরশেঠী (ধনী ব্যক্তি), বণিক, কারিগর, করণিক (কায়স্থ) ইত্যাদি শ্রেণী পেশার মানুষ ছিলেন। পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগের নাম ছিল ‘বীথি। সবচেয়ে ছােট প্রশাসনিক বিভাগ ছিল ‘গ্রাম। গ্রামের প্রধানরাই এর প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকতেন। গ্রামগুলােতে ভূমিদান, দলিল সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে গ্রাম প্রশাসন যুক্ত থাকত। 

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে গুপ্তযুগকে সুর্বণযুগ বলা হয়। এই সময়েই ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, শিল্প, চিকিৎসাবিদ্যা, বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র ও সাহিত্য অভূতপূর্ব প্রসার লাভ করেছিলাে। এই গুপ্তযুগেই আর্থিক কাঠামাের মূল বুনিয়াদ ছিলাে কৃষি, শিল্পবাণিজ্য এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের নবজাগরণ। সমাজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রি-মূর্তির পূজার প্রচলন শুরু হয়। এই সময়েই বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মের স্ফুরণ ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বেড়ে যায়। বুদ্ধদেবকে গুপ্তযুগে হিন্দুরা অন্যতম অবতার হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার মূর্তি পূজার প্রচলন শুরু করে। এর ফলে দেখা যায় হিন্দুধর্ম হলাে পৌরাণিক ধর্ম; যার মধ্যে আর্য ও অনার্য ধর্মের সম্মেলন ঘটেছে।[২]

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের ইতিহাস হচ্ছে পূর্ববঙ্গের জনগণের লড়াই ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস

গুপ্ত যুগে ভূমি ব্যবস্থা ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। চাষযােগ্য, বাসযােগ্য, অকর্ষিত, খিল (পতিত) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জমি বণ্টন ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। বাংলার ইতিহাসে প্রশাসনিক এবং ভূমি ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে গুপ্তদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। গুপ্ত যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল।

৬ষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য অন্তঃর্বিবিদ্রোহ ও হুণজাতির বার বার আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই অস্থিতিশীল পরিবেশে বাংলাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। এর একটি হচ্ছে স্বাধীন ‘বঙ্গ রাষ্ট্র, অপরটি ‘গৌড় রাজ্য এবং এই ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসে ধ্রুপদী বাংলা গড়ে ওঠে।

গুপ্ত যুগে উত্তরবঙ্গ

গুপ্তশাসনের পতনের পর উত্তরবঙ্গ বিদেশি আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠে। এই সময় গুপ্তবংশের নামে একটা অংশ উপাধিধারী রাজার সাম্রাজ্যের একটা অংশ অধিকার করেন। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে বঙ্গদেশের এই অঞ্চল গৌড় নামেই প্রসিদ্ধ লাভ করে। গুপ্ত রাজাদের অধীনে গৌড় একটা গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রূপে পরিচিত লাভ করে। কিছুদিনের ভেতরে পরাক্রান্ত রাজা ঈশান বর্মা গৌড়রাজ দখল করে উত্তরবঙ্গে মৌখরি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মৌখরি বংশের ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ অল্প কিছুদিনের মধ্যে গুপ্তরাজ কুমারগুপ্ত ঈশান বর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং কুমার গুপ্তের পুত্র দামােদর গুপ্ত মৌখরিদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে হারানাে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তবে গুপ্ত রাজাদের শাসনও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ প্রতিনিয়ত তাদেরকে কোথাও না কোথাও কারাের সাথে যুদ্ধে করতে হয়েছে। ফলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।[২]

তথ্যসূত্র:

১. পাটোয়ারী মমতাজউদ্দীন, আকতার শাহীনা, ও ইসলাম মো. জাকিরুল. বাংলাদেশ স্টাডিজ. “প্রাচীন বাংলার ইতিহাস”, ঢাকা , বাংলাদেশ: বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়. প্রকাশকাল ২০১৪, পৃষ্ঠা ১।
২. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-১৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!