পরিচয়: শতাবরী বা শতমূলী (বোটানিকাল নাম Asparagus racemosus Willd.,) লিলিয়াসি পরিবারের অ্যাসপারাগাস গণের একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ। শতমূলী লতাটির প্রকৃতি স্বাভাবিক ভাবেই লতানো। তবে বলা যায় এটি বৃক্ষাশ্রয়ী এবং শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। পাতাগুলি দেখলে মনে হয় যেন সবুজ সুতোর ঝিলিমিলি মালা গাঁথা, এইজন্য বহু সৌখীন লোক বাড়ীর উদ্যানের শোভাবর্ধন করার জন্য এটি রোপণ করেন। আর যে কারণে এর নাম শতাবরী বা শতমূলী তা কিন্তু এর মূলের পরিচয়ে; কারণ এর শিকড়গুলি গুচ্ছবদ্ধ সরু মূলো (Raphanus Sativus) এবং গাজরের (Daucus carota) মতো। এর লতায় বাঁকা কাঁটা হয়। ফুলের মঞ্জরী হয়, সেগুলি ১ থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা; সে দন্ডটি সরুও হয়। শতমূলী লতার শরতেই ফুল ও ফল হয়, পাকে মাঘ ফাল্গুনে। ফলে একটা সুগন্ধও থাকে। ছোট মটরের মতো সবুজ ফল, পাকলে লাল হয়, গাছ বহুদিন বাঁচে, সাধারণত বেলে বা দোআঁশ মাটিতে এর মূলগুলি খুব পুষ্ট হয়। এক একটি পুরনো গাছে ১০ থেকে ১২ কিলোগ্রাম পর্যন্ত মুল পাওয়া যায়।
ঔষধার্থে ব্যবহার হয় মূল ও পাতা। আয়ুর্বেদে শতাবরী ও মহাশতাবরী নামে দুটি প্রকারভেদের উল্লেখ রয়েছে, তবে অনেকের মতে এটির বৈজ্ঞানিক নাম Asparagus Sarmentosus Linn. এই মহাশতাবরীর জন্ম বেশীর ভাগই দক্ষিণ ভারতে; এর লতাও বেশ বড় হয়, এমনকি বড় গাছের উচ্চতা যতখানি প্রায় ততদূর এর বৃদ্ধি।
লৌকিক ব্যবহার
প্রথমেই জানাই যে, রসবহ স্রোত এবং রক্তবহ স্রোত দূষিত হয়ে যে যে রোগ হয়, সেখানে শতমূলে উপকার হয় এবং সেখানে শতমূলের অচিন্ত্য প্রভাবই (immense strength) কাজ করে।
১. রক্তামাশয়ে: রোগটি সহজ ভেবে ঔষধ দেওয়াটা সম্ভব হয় না, যদিও ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ করে আমের সঙ্গে একটু রক্ত যাচ্ছে। এখানে কোনো ঠান্ডা জিনিস খেলেও যে রক্তপড়া বন্ধ হবে তাও নয়, আবার কোনো উষ্ণগণুসম্পন্ন যেমন-আদা, মরিচ প্রভৃতি খেলে যে সেরে যাবে তাও নয়; যে দ্রব্যের প্রকৃতিটা বীর্যবত্তায় শীত উষ্ণে, সেই শীতোষ্ণ দ্রবই এক্ষেত্রে বেশী উপযোগী; তাই শতমূল বেটে রস করে ৪ চা চামচ আন্দাজ নিয়ে ৭/৮ চা চামচ দুধ মিশিয়ে প্রত্যহ সকালে ও বিকালে ২ বার খেলে। দুই এক দিনের মধ্যেই ওটা সেরে যাবে।
২. রক্তমূত্রে: এটা তিন চারটি কারণে হতে পারে। (ক) অতিরিক্ত স্ত্রী সহবাস করলে, (খ) কোনো গরম জিনিস এক নাগাড়ে দীর্ঘদিন খেতে থাকলে, (গ) অত্যধিক উষ্ণ জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করতে থাকলেও হয়; আবার উষ্ণপ্রধান দেশে উপস্থিত হলে, সেই দেশের প্রচলিত আহার বিহার না মেনে চললেও রক্তবর্ণ প্রস্রাব হতে দেখা যায়; সেক্ষেত্রে ১০/১৫ গ্রাম শতমূলী বেটে, দুধের সঙ্গে জল মিশিয়ে পাক করে এক্ষেত্রে দুধ ১১৪ মিলিলিটার বা আধ পোয়া আন্দাজ আর জল ৫০০ মিলিলিটার বা আধ সের আন্দাজ দুগ্ধাবশেষ থাকতে নামিয়ে ছেকে সকালে অর্ধেকটা ও বিকালে অর্ধেকটা করে খেতে পারলে ভাল হয়। এর দ্বারা ঐ রক্তবর্ণ প্রস্রাব আর থাকবে না।
৩.অপষ্মার রোগে (এপিলেপসিতে): এ রোগের লক্ষণ চিরঞ্জীব বনৌষধি’র প্রথম খণ্ডের ৩২৯ পৃষ্ঠায় দেওয়া আছে। এই রোগটি আয়ুর্বেদের চিন্তাধারায় রক্তে জন্য মূর্ছা রোগ। এক্ষেত্রে শতমূলীর রস ৩/৪ চা চামচ সিকি কাপ কাঁচা দুধে মিশিয়ে সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে হবে। কিছুদিন ধরে না খেলে এটা সারবে না, কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস খেতে হবে। অবশ্য আস্তে আস্তে এই আক্রমণের তীব্রতা কমে যাবে। এটা চরক সংহিতার ব্যবস্থা (চিঃ ১৫ অঃ) ।
৪. ফাইলেরিয়ায়: এর সঙ্গে জ্বর, এটা অনেক সময় প্রথমে আসে রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় কাঁপুনি দিয়ে; তার সঙ্গে অনেকের মুষ্কটি [অন্ডকোষ] ফুলে যায়, কারও কারও রসও গড়ায়। শুধু তা কেন; হাতে, পায়ে, লিঙ্গে, জননেন্দ্রিয়েও হয়ে থাকে। এইসব যে ক্ষেত্র এখানে শতমূলীর রস ২ চা চামচ, তার সঙ্গে এক চা চামচ, আখের বা ইক্ষুর গুড় মিশিয়ে সরবত করে প্রত্যহ একবার করে খেতে হয়। আর এটা ২ বা ৪ দিন খেলে হবে না, দীর্ঘদিনই খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
৫. রাতকানা রোগে (নন্তান্ধতায়): এই রোগটির আয়ুর্বেদীয় বিজ্ঞান হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মে সন্ধ্যায় তেজগুণের হ্রাস হয় এবং সোমগুণের আধিক্য ঘটতে থাকে, এটাতে স্বভাবতই কফের কাল এসে পড়লো,তার উপর সূর্যের আলোও চলে গেল, এদিকে অক্ষিগোলকের বিন্দুটি কফাবৃত হয়ে পড়লো।
এখন মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে-আলোর অভাব যদি এর মুখ্য কারণ হয়, তাহলে দিনের বেলায় অন্ধকার ঘরে তার কি এই রাত্যন্ধতার অসুবিধা আসবে? হ্যাঁ আসবে—যদি দুপুরেবেলা ভাত খাওয়ার পর কোনো ঘর অন্ধকার করে ঘুম যায়, তারপর ঘুম থেকে উঠলে তার ঐ অসুবিধাটা হচ্ছে, সেটা খানিকটা বোঝা যাবে। যেহেতু সে খেয়ে ঘুমিয়েছে, তার জন্য তার শরীরে শ্লেষ্মার প্রাধান্য এসেছে, তাই এই অসুবিধাটা। এখানের মৌলিক কারণ হচ্ছে রক্তবহ স্রোতটাই শ্লেষ্মার বিকারগ্রস্ততা। এক্ষেত্রে প্রত্যহ ৫/৭ গ্রাম শতমূলী লতার পাতা গাওয়া ঘিয়ে ভেজে খেতে হবে। এর দ্বারা কয়েকদিনের মধ্যে আর রাতকানার দোষ থাকবে না। এটা হলো বাগভটের ব্যবস্থা, আছে উত্তরতন্ত্রে ৩৯ অধ্যায়ে ।
৬. মূত্রকৃচ্ছ: পাথুরী যে হয়েছে তাও নয়, অথচ কষ্টে প্রস্রাব হচ্ছে, তখনই বুঝতে হবে যে, রসবাহ ও রক্তবহ স্রোত দূষিত হয়েছে; এক্ষেত্রে শুষ্ক শতমূলীকে চূর্ণ করে ১ গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে ঠান্ডা জলসহ খেলে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে মূত্রের কৃচ্ছতা চলে যাবে।
৭. পিত্তশূলে (Biliary colic): এই রোগটা সাধারণত শরৎকালে দেখা দেয়, আবার শীতের সময় কমে যায়, কোনো ঠান্ডা জিনিস অথবা কোনো মিষ্টি সরবত খেলেও কমে যায়; এ ব্যথা কিছু খাওয়ার পরেই আসে, আবার এটা বমি হলেও কমে যায়; এক্ষেত্রে সকালবেলা খালিপেটে শতমূলী লতার রস ২/৩ চা-চামচ একটা আধ কাপ আন্দাজ কাঁচা দুধ মিশিয়ে খেলে ওটার শান্তি হবে; তবে কোনো পিত্তকর দ্রব্য, যেমন ঝাল, টক, ডিম, শাক প্রভৃতি যতদূর সম্ভব বর্জন করে চলাই ভালো।
৮. রক্তপিত্ত রোগ: এটা দীর্ঘদিন পুষে রাখলে যক্ষ্মা পর্যন্তও হতে পারে। এটা দেখা দিলে শতমূলীর রস ৩/৪ চা-চামচ, দুধ আধ পোয়া আন্দাজ আর দুধের সমান পরিমাণ পানি নিয়ে একসঙ্গে সিদ্ধ করে ঐ দুধটা অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে ঐটা সকালে খেতে হবে। যদি অগ্নিবল কম থাকে, তবে ঐটাকে সকালে ও বিকালে দুবারে ভাগ করে খেতে হবে। এর দ্বারা রক্তপিত্তের শান্তি হবে। এ ব্যবস্থাটা ভাবপ্রকাশকার ভাবমিশ্রের।
৯. স্তন্য শুষ্কতা: স্বাস্থ্য যে খারাপ তাও নয়, অথচ স্তনে দুধ নেই। এক্ষেত্রে শতমূলী লতার রস ২ চা চামচ, দুধ ১১৪ মিলিলিটার বা আধ পোয়া আন্দাজ আর চিনি এক চা চামচ, একসঙ্গে সরবত করে সকালে একবার ও বিকালের দিকে একবার খেতে হবে; এর দ্বারা ৩/৪ দিন পর থেকে বুকে দুধ আসবে।
১০. বিসর্প বা নারাঙ্গা রোগ (ইরিসিপ্লাস): এখন পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক অমোঘ ঔষধি বেরিয়েছে সত্যি, কিন্তু যখন সাধারণ লোক নিরুপায় ছিলো, তখন এই রোগ এসে পড়েছে দেখলে শতমূলী লতার বাটা, সকালে ও বিকালে দুবার লাগানো হতো। এটা কিন্তু সুশ্রুতের ব্যবস্থা; আছে চিকিৎসাস্থানের ১১ অধ্যায়ে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ১৬৬-১৭৩।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: RaffiKojian
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।